১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈঠক

গাজার দক্ষিণ রাফায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের হামলায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারি : আলজাজিরা -

- নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক
- ইসরাইলের দায়মুক্তি চলতে পারে না : জাতিসঙ্ঘ
- রাফার কেন্দ্রস্থলে অবস্থান নিয়েছে ইসরাইলি ট্যাংক

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় হামলা চালানোয় ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে প্রথমবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত সোমবার আইরিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন না মানায় ইসরাইলের ওপর এমন পদক্ষেপের কথা ভাবছেন ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। পররাষ্ট্রবিষয়ক কাউন্সিলের পর সাংবাদিকদের মার্টিন বলেন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমুন্নত রাখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে স্পষ্ট ঐকমত্য ছিল। আলজাজিরা, রয়টার্স, আনাদোলু ও এএফপি।
শুক্রবার আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রায় দিয়েছে যে, ইসরাইলকে অবিলম্বে রাফাহতে হামলা বন্ধ করতে হবে এবং অবরুদ্ধ এলাকায় মানবিক সাহায্য প্রবেশের অনুমতি দিতে সীমান্ত ক্রসিং খুলে দিতে হবে। তারপরও রাফাহতে হামলা অব্যাহত রাখে ইসরাইলি বাহিনী। রোববার তাল আস-সুলতান এলাকার শরণার্থী শিবিরে হামলায় নারী ও শিশুসহ অন্তত ৪৫ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ইইউ নেতারা।
মার্টিন আরো বলেছেন, রাফাহতে হামলা বন্ধ করতে আইসিজের রায় মেনে না নিলে ইসরাইলের ওপর সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাব্য ব্যবস্থা নিয়ে কার্যকর আলোচনা হয়েছে। কিছু মতপার্থক্য থাকলেও বিষয়টি নিয়ে আরো আলোচনা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, এমনকি পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনে মদদদাতা ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি উত্থাপন করেন কয়েকজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

রাফার কেন্দ্রস্থলে ইসরাইল
অভিযান শুরুর প্রায় তিন সপ্তাহ পর গাজার দক্ষিণের শহর রাফার কেন্দ্রস্থলে অবস্থান নিয়েছে বেশ কয়েকটি ইসরাইলি ট্যাংক। মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো এসব ট্যাংক শহরটিতে প্রবেশ করে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। তারা জানিয়েছেন, রাফার কেন্দ্রস্থল আল-আওদা মসজিদের কাছে ইসরাইলি ট্যাংক দেখা গেছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এটি পরে রাফা অভিযান সম্পর্কে বিবৃতি দেবে বলে উল্লেখ করেছে।

ইসরাইলকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান
যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান কিংবা হুমকি উভয়ই উপেক্ষা করে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এতে বেসামরিকদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সর্বশেষ রোববার রাফাহ শহরের শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় ৪৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এই ঘটনার পর আবার বেসামরিকদের সুরক্ষার জন্য ইসরাইলকে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার আহ্বান জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। কেননা, ইসরাইলে মার্কিন অস্ত্রের চালান বন্ধ করার জন্য নিজ দলের কর্মীদের চাপে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষেদের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘ইসরাইলের হামাসকে ধাওয়া করার অধিকার আছে। তিনি আরো বলেন, ‘তবে এ বিষয়টিও আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, ইসরাইলকে অবশ্যই বেসামরিকদের সুরক্ষার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’ ইসরাইলের প্রতি সমর্থন ফিরিয়ে নেয়ার জন্য নিজের দলের মধ্য থেকে ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এমনকি রোববার রাতে হওয়া বিমান হামলার আগেও এ নিয়ে বাইডেনকে চাপ দেন তার সহকর্মীরা।
মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের একজন বিশিষ্ট ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ। সোমবার এই হামলাকে ‘একটি অবর্ণনীয় নৃশংসতা’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা একটি পোস্টে আলেকজান্দ্রিয়া বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্টের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও সামরিক সহযোগিতা স্থগিত করার উদ্যোগ নিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা একটি পোস্টে প্রতিনিধি আয়ানা প্রেসলি বলেছেন, ‘গত রাতে রাফাহ থেকে ভয়ঙ্কর সব ছবি এসেছে।’ এ সময় তিনি প্রশ্ন করেন, ‘ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা ও ক্ষত-বিক্ষত করার সময় আর কত দিন ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর পাশে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র?’
কংগ্রেসে একমাত্র ফিলিস্তিনি-আমেরিকান প্রতিনিধি রাশিদা তুলাইব। তিনি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘গণহত্যা চালাতে মরিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন। সোমবার নেতানিয়াহু বলেছিলেন, বেসামরিক হতাহতের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তাদের। তবে ‘দুঃখজনকভাবে ভুল’ করে তা ঘটেছে।

নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক
রাফায় ইসরাইলের বিমান হামলা নিয়ে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। আলজেরিয়া এই বৈঠক ডাকার অনুরোধ করেছিল। তাদের সমর্থন করেছে স্লোভেনিয়া। কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, এই বৈঠক রুদ্ধদ্বার হবে। জরুরি ভিত্তিতে এই বৈঠক ডাকা হয়েছে। রাফায় ইসরাইলের বিমান হামলার পর হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, ওই হামলায় ৪৫ জন মারা গেছেন এবং অনেক মানুষ আহত হয়েছেন।
জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস এই বিমান হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিরপরাধ বেসামরিক মানুষরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের ওপর ইসরাইলের এই হামলার নিন্দা করছি। গাজায় কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। এই আতঙ্ক শেষ হওয়া উচিত।’ জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক বলেছেন, ‘ওই শিবিরে হামলা হওয়ার পর যে ছবি সামনে এসেছে তা ভয়ঙ্কর।
ইসরাইল যেভাবে যুদ্ধ করছে, তাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। রোববারের বিমান হামলা একটা জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছে, গাজায় কোনো নিরাপদ জায়গা নেই।’ তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি ইসরাইলের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি, তারা যেন আইসিজের নির্দেশ মেনে রাফায় আক্রমণ বন্ধ করে। দুই পক্ষের অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা উচিত।’

দায়মুক্তি চলতে পারে না
ইসরাইলের ‘দায়মুক্তি চলতে পারে না’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তা ও জরুরি ত্রাণবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি মার্টিন গ্রিফিথস। একই সাথে গাজার নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। রাফায় ইসরাইলি বিমান হামলায় বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনির হতাহতের ঘটনার পর এই প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। মঙ্গলবার বার্তাসংস্থা আনাদোলুর খবরে বলা হয়েছে, জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ প্রধান সোমবার দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে বাস্তুচ্যুত লোকদের শিবিরে ইসরাইলি বিমান হামলার নিন্দা করে বলেছেন, ‘এ ধরনের দায়মুক্তি চলতে পারে না।’
সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেয়া এক বার্তায় মার্টিন গ্রিফিথস লিখেছেন, ‘গাজা থেকে আরেকটি ভয়ঙ্কর আপডেট পেলাম। গত রাতে রাফাতে ইসরাইলের বিমান হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু জীবন্ত পুড়ে মারা গেছেন।’ গাজায় ত্রাণ বিতরণে চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে গ্রিফিথস বলেন : ‘নানা প্রতিবন্ধকতা এবং তীব্র লড়াইয়ের কারণে আমরা এখনো কেরেম শালোম থেকে পণ্যগুলো নিতে পারিনি।’
গ্রিফিথস বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন : ‘এই ধরনের দায়মুক্তি চলতে পারে না। বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করুন। তাদের নিরাপদ জায়গা খোঁজার সুযোগ দিন। তাদের সাহায্য পেতে দিন।’

 


আরো সংবাদ



premium cement