১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মাফিয়া ও দালালের খপ্পরে সর্বস্ব হারাচ্ছেন মাদারীপুরের তরুণরা

-


অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
শতাধিক যুবক নিখোঁজ পরিবারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

প্রবাসী অধ্যুষিত মাদারীপুরসহ দেশের তরুণদের ইউরোপ যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এসব তরুণের টার্গেট করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র। বাংলাদেশ-লিবিয়ার এ চক্রের সদস্যরা লোভনীয় সুবিধা দেখিয়ে তরুণদের কৌশলে ফাঁদে ফেলে। প্রথমে দেশে কয়েক দফা তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়। পরে তাদের পাঠানো হয় লিবিয়া। বলা হয়, সেখান থেকে তাদের ইউরোপ পাঠানো হবে। এরপর সেখানেও ধাপে ধাপে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে গেইম ঘরে জিম্মি করে রাখা হয়। টাকা না দিলে নেমে আসে নির্যাতন। সম্প্রতি মানব পাচার চক্রের মূল হোতা মাদারীপুরের দেলো ওরফে দেলোয়ার সরদারকে লিবিয়ায় সবাই চেনে মাফিয়া সরদার নামে। তার নেতৃত্বেই মুক্তিপণের জন্য লিবিয়ার ‘গেম ঘরে’ আটকে থাকা দেড় শতাধিক যুবকের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। নতুন করে প্রায় তিন শতাধিক যুবক ইতালী যাওয়া নিয়ে নগদ টাকা, ভিটে-মাটি ও একমাত্র বসতভিটা মাফিয়া দেলোয়ার সরদারের নামে সাফ-কবলা বা দলিল করে দিয়েও রয়েছে চরম আতঙ্কে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের মৃত রশিদ সরদারের ছেলে দেলোয়ার সরদার (৪০) দীর্ঘদিন ধরে ইতালী প্রবাসী ছিলেন। দেলোরয়ার সরদার মানব পাচার করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর নৌকায় পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পাঠানোর ‘মরণযাত্রা’র জন্য মাদারীপুরের সবখানেই দেলোয়ার সরদারসহ মাফিয়া ও দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। এসব দালালচক্র মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে তারা। ইতালি পাঠানোর কথা বলে তারা জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে মানুষ তাদের জমিজমা বিক্রি করে দিচ্ছে। ঢাকা ও দুবাইয়ে অবস্থান করে লিবিয়া-বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করা চক্রের সাথে সম্পৃক্ত স্থানীয় দালালরা। ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে প্রথমে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা নিয়ে দালালরা বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে লিবিয়া পাঠায়। এরপর সেখান থেকে নৌপথে ইউরোপের দেশ ইতালি পাঠানোর কথা বলে। এর মধ্যেই বিদেশগামীদের বিপত্তিতে পড়তে হয়। নৌপথে পাড়ি দিতে গিয়ে স্থানীয় মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়ে তারা। টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার পাশাপাশি অনেককেই প্রাণ হারাতে হয় ভূ-মধ্যসাগরে।

ভুক্তভোগী অনেক পরিবার জানায়, কৌশলে আরো টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য মাফিয়া চক্রের কাছে ধরিয়ে দেয় দেশী দালাল চক্র। মাফিয়ারা তাদের লিবিয়ার বিভিন্ন টর্চার সেলে নিয়ে বন্দী করে রাখে। সেখানে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এ ছাড়া পানি ও খাবার বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই টর্চার সেল থেকে ছাড়ানোর জন্য পরিবারের সাথে ফের যোগাযোগ করে দালাল চক্র। এরপর ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ছাড়িয়ে আনা হয়। এভাবে ফের নৌপথ দিয়ে পাড়ি দিতে গিয়ে একাধিকবার মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়তে হয় ভুক্তভোগীদের। বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা খোয়াতে হয়। অনেক পরিবার আছে, যারা প্রশাসন ও সাংবাদিকদের কাছে এ নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। কারণ, তথ্য ফাঁস করে দিলে মাফিয়ারা তাদের সন্তানদের মেরে ফেলবে। বিভিন্ন ভুক্তভোগীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, দালালদের বেশির ভাগই ঢাকা শহরে বসবাস করে। এক একটি মোবাইল সংযোগ ২০-২৫ দিনের বেশি তারা ব্যবহার করে না। মাদারীপুরে এই দালালদের একাধিক চক্র সক্রিয়। এর মধ্যে রয়েছে মাদারীপুর সদর উপজেলার বড়াইলবাড়ী গ্রামের জামাল খাঁ, কেন্দুয়ার রিপন সরদার ওরফে বোম্বাই রিপন, বালিয়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেন ওরফে মাফিয়া দেলো, মাদারীপুর শহরের ডিসি ব্রিজ এলাকার রাশেদ খান ও টুলু খান। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের তুলাতলা। মাদারীপুর শ্রীনাথদি বাজিতপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, ধুরাইল ইউনিয়নের চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, আলমগীর, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাস তালুকদার, হোসেনপুরের জাকির হোসেন, টেকেরহাটের লিয়াকত মেম্বার, কদমবাড়ীর রবিউল ওরফে রবি, শাখারপাড় গ্রামের কামরুল মোল্লা, এমরান মোল্লা, আমগ্রাম ইউনিয়নের কৃষ্ণার মোড় এলাকার শামীম ফকির, সম্রাট ফকির, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের শহিদুল মাতুব্বর ও সিরাজ মাতুব্বর, ডাসার উপজেলার সিদ্দিক বয়াতির ছেলে সাগর বয়াতী, মস্তফাপুরের বালিয়া গ্রামের এমদাত ফকির দালাল হিসেবে সক্রিয়। দালাল এমদাত ফকির এলাকার অনেক লোকজনের থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব দালালের গডফাদার হচ্ছে লিবিয়ায় অবস্থানরত মাফিয়া শরীফ ও আশরাফসহ বেশ কয়েকজন। শরীফের শ্বশুরবাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলা শিরখাড়া ও আশরাফের শ্বশুরবাড়ি সদর উপজেলার খোয়াজপুরে। এই সূত্রে তাদের শক্ত সিন্ডিকেট রয়েছে মাদারীপুরে। এ চক্রের সাথে রয়েছে বেশ কিছু নারী দালালও। তারা কমিশনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিদেশগামী যুবকদের সংগ্রহ করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, লিবিয়ায় আটকে রেখে যে নির্যাতন করা হয়, এর দেশি মূল হোতা কুমিল্লার বাসিন্দা শরীফ। তিনি মাফিয়া হিসেবে পরিচিত। মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের নতুন মাঠ গ্রামের সাকা মাতুব্বরের মেয়ে সুমিকে বিয়ে করেন শরীফ। সুমিসহ একাধিক দালাল মাদারীপুর সদর, শিবচর, কালকিনি, ডাসার, রাজৈর ও পাশের জেলা গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে লোক সংগ্রহ করে লিবিয়ায় পাঠায়। লিবিয়ায় যারা নির্যাতন করে, তাদেরই একজন আজিজুল ইসলাম নির্ঝন। তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের চরনাচনা গ্রামের আবুল কালাম হাওলাদারের ছেলে। তিনি লিবিয়ায় পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর জোয়ারা ক্যাম্পের মাফিয়া শরীফ হোসেনের সহযোগী। তার দায়িত্ব বন্দীদের নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা। নির্যাতন করার জন্য নির্ঝনকে প্রতি ঘণ্টায় ৩০ হাজার টাকা দেয় শরীফ। সদর উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের ভুক্তভোগী রাকিব ফরাজী বলেন, শরীফের ক্যাম্পে নির্ঝন আমাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর আবারো মেরেছে। মারার ফলে আমার চোখে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। ক্যাম্পে থাকার দুই মাসের মধ্যে নির্ঝনের নির্যাতনে দুই যুবক মারা গেছে। আরেক ভুক্তভোগী ডাসার উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বনি আমিন। তাকে মুক্তিপণের জন্য কয়েক দফায় নির্যাতন চালানো হয়। পরে শরীফের স্ত্রী সুমির এজেন্ট ব্যাংকিং নম্বরে ২০ লাখ টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

ডাসার উপজেলার দক্ষিণ ডাসারের ছিদ্দিক বয়াতি ও তার স্ত্রী হনুফা বেগম এবং তার ছেলে ইতালি প্রবাসী সাগর বয়াতি ডাসার ইউনিয়নের সাকিব শিকদার (২৬) নামে এক যুবককে ইতালি নেয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাকিব শিকদার নামে ওই যুবককে ইতালির পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ার বন্দীশালায় আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়ে পরিবারের কাছে বারবার টাকা দাবি করে আসছে। একই গ্রামের জসিম হাওলাদার (৩৫) নামে এক যুবককের চার মাস ধরে সন্ধান মিলছে না। এতে পাগলপ্রায় তাদের পরিবারের লোকজন। দালাল সাগর বয়াতী ও সিদ্দিক বয়াতীকে সেল্টার দিচ্ছেন একই এলাকার সাবেক মেম্বার মফেজ সরদার।

ভুক্তভোগী সাকিব শিকদারের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার একমাত্র ছেলেকে ঠাস-ঠাস করিয়া মারে। আর বলে টাকা দে, ছেলের আর্তনাদে মা হইয়া সহ্য করতে পারি না। আমার ছেলেরে আমি ফেরত চাই। লিবিয়ায় নিখোঁজ জসিম হাওলাদারের স্ত্রী জানান, আমার স্বামী জসিমকে সিদ্দিক বয়াতি ও সাগর বয়াতি ইতালির যাওয়ার কথা বলে আট লাখ টাকা নেয়। টাকা নেয়ার পর আমার স্বামীর আজ প্রায় চার মাস হলো কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমি আমার তিনটা সন্তান নিয়ে কষ্টে আছি। আমি আমার স্বামীর খোঁজ চাই, আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই। মফেজ মেম্বার মীমাংসার নামে টালবাহানা করছে।

মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, মাদারীপুর তথা দক্ষিণাঞ্চলে মূলত নেই কোনো কলকারখানা। নেই কর্মসংস্থান। তাই বিদেশ যাওয়ার দিকে ঝুঁকছে মানুষ। অন্য দিকে যারা বিদেশ যাচ্ছে তারা দেশে এসে বহুতল ভবন তৈরি করছে। পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাচ্ছে। এদের দেখাদেখি লেখাপড়া শেষ না করেই বিদেশ যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু করে অনেকেই। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি হচ্ছে শত শত যুবক। তাই তিনি এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামাতে স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির দাবি জানান। মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: কামরুল হাসান বলেন, অনেক ভুক্তভোগী দেশে ফিরে মানবপাচার আইনে মামলা করেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপস করে ফেলে। যার কারণে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। তিনি বলেন, মানব পাচার ঠেকানোর জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ হলো অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা। মূলত মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে এগিয়ে আসা দরকার।

 


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশী জেলে ভারতে ধরে নিয়ে যাওয়ায় জামায়াতের উদ্বেগ বিস্ফোরণে আফগান শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী নিহত জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে ষড়যন্ত্রকারীরা অবশ্যই ব্যর্থ হবে : আমিরে জামায়াত অবসরে গেলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ জিয়াউল করিম জাতিসঙ্ঘের আরো জোরদার সহযোগিতার আহ্বান ঢাকার আওয়ামী লীগ একটি পাপিষ্ঠ দলের নাম : মাসুদ সাঈদী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলা : কুলাউড়ায় আ’লীগ নেতা আজাদ গ্রেফতার খুনকে অপমৃত্যু হিসেবে রেকর্ড করলেই ওসি দায়ী : ডিএমপি কমিশনার সিরিয়াকে বশে রাখতে দামেস্কের কাছে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে চায় ইসরাইল ভারতের সাথে বিদ্যুৎ নিয়ে চুক্তিগুলো বাতিল সহজ নয় : রিজওয়ানা হাসান গৌরনদীতে মাদককারবারির কারাদণ্ড

সকল