১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
‘ঘুষ দিলে চাকরি থাকে, না দিলে থাকে না’

নড়াইলে ইফার উপ-পরিচালক ও ফিল্ড সুপারভাইজারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

-

খোদেজা বেগম নড়াইল শহরের ভওয়াখালী এলাকার বাসিন্দা। ১৯৯৮ সালে তার স্বামী মারা যাওয়ার সময় বড় ছেলের বয়স ছিল ১২ বছর। আর ছোট সন্তান প্রায় আট বছরের। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারে হাল ধরার মতো কেউ ছিল না তার। প্রথমে ব্র্যাকের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রে ৫০০ টাকার বেতনে চাকরি করতেন। এরপর ২০০৬ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের চাকরি নেন। প্রথম দিকে এখান থেকে সম্মানী পেতেন ১২০০ টাকা। সবশেষ পেয়েছেন পাঁচ হাজার টাকা। চাকরির শুরু থেকে প্রায় ১৮ বছর সুষ্ঠুভাবে কেন্দ্র পরিচালনা করে এলেও খোদেজা বেগমকে বয়স বিবেচনায় হঠাৎ করে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। যদিও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়মানুযায়ী ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করা যায়। এখন তার বয়স ৬১ বছরের কাছাকাছি। দুঃখভারাক্রান্ত মনে চাকরি ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন খোদেজা বেগম।
একই অবস্থা আরেক বিধবা লোহাগড়া উপজেলার মাকড়াইল খানপাড়া কেন্দ্রের শিক্ষক সানজিদা খানমের। তিনি বলেন, এই চাকরি আমার সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে আমি তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে কোনো রকম সংসার চালাই। হঠাৎ একদিন সকাল সাড়ে ৭টায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে পরিদর্শনে এসে কোনো ছাত্রছাত্রী না দেখে আমাকে বিনা নোটিশে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ আমার কেন্দ্রে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা সকাল সাড়ে ৯টায়। তাহলে এত সকালে কিভাবে ছাত্রছাত্রী দেখতে পাবে? আমি অসহায় নারী, প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন আমার চাকরিটা ফিরিয়ে দিন। একইভাবে নড়াইল জজকোর্ট মসজিদের সাবেক ইমাম হাফেজ মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামানকে বিনা কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এমন হয়রানির শিকার শুধু খোদেজা, সানজিদা ও মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামানই নন নড়াইলে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের এমন ভুক্তভোগী শিক্ষকের সংখ্যা ৪৫ জন।
নড়াইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান ও ফিল্ড সুপারভাইজার ফাইজার রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। জেলার ৪৮২টি মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানি করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন অঙ্কের উৎকোচ না দেয়ার কারণে গত এক বছরে ৪৫ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, সেইসব শূন্য পদের বিপরীতে অর্থের বিনিময়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ করেছেন।
শিক্ষকদের লিখিত অভিযোগে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১ মার্চ বর্তমান উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম শুরু হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠেছে। এ দিকে শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান এবং ফিল্ড সুপারভাইজার ফাইজার রহমানসহ অফিস সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। নিয়োগ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিস থেকে সম্প্রতি ০১৯১৪-৬৬৭৮২৬ মোবাইল ফোন নাম্বারে দেড় লাখ টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। যার কলরেকর্ড ভুক্তভোগীর কাছে সংরক্ষিত আছে।
জেলার কালিয়া উপজেলার বাবরা মধ্যপাড়ার সোনিয়া পারভীন বলেন, প্রায় আট মাস আগে ফাউন্ডেশন অফিস থেকে আমার কাছে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। আমি নিয়মিত কেন্দ্র পরিচালনা করলেও ৩০ হাজার টাকা দিতে না পারায় আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জানুয়ারি থেকে সম্মানীর পাঁচ হাজার টাকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিলে চাকরি থাকে, না দিলে থাকে না।
এ দিকে উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে শুধু ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ নয়, তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা রকম আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। ২০২৩ সালে ৪৮২ জন শিক্ষকের কাছ থেকে জাকাতের কথা বলে জোরপূর্বক জনপ্রতি এক হাজার টাকা করে মোট ৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। একই কথা বলে চলতি বছরে নেয়া হয়েছে জনপ্রতি দুই হাজার টাকা করে। এ ক্ষেত্রে মোট টাকার পরিমাণ ৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ভুক্তভোগী অনেকের অভিযোগ সমাজ থেকে আমরাই জাকাত পাওয়ার যোগ্য। অথচ আমাদের কাছ থেকে জাকাতের নামে অবৈধ টাকা তোলা হয়েছে। বিগত উপ-পরিচালকদের সময়ে এমন ঘটনার নজির নেই। অপর দিকে ২০২৩ সালের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর ইমাম সম্মেলনে নড়াইল থেকে ৫০০ ইমাম ঢাকায় যোগদান করায় সম্মানীবাবদ প্রত্যেককে এক হাজার ২০০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও তাদের কোনো টাকাই দেয়া হয়নি। বিভিন্ন এলাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে জনসচেতনতামূলক উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও শিক্ষকদের কোনো সম্মানী দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে নড়াইল সদরের কমলাপুর কেন্দ্রের শিক্ষক মাওলানা কারী ইদ্রীস আলী বলেন, আমার উঠান বৈঠকে ৪০ জনের বেশি উপস্থিত ছিল। আমাকে সম্মানী বাবদ ১৫০০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও আমি আজো কোনো টাকা পাইনি। ফিল্ড সুপারভাইজার ফাইজার রহমানের কাছে টাকা চাইলে তিনি বলেন, আমি টাকা কাকে দেবো না দেবো, সেটা আমার বিষয়। অভিযোগ করে কোনো লাভ হবে না। ভুক্তভোগী শিক্ষক কারী ইদ্রীস আলী ঘটনাটি উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে জানালে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি দেখছি।
জানা গেছে, মিজানুর রহমানের বাড়ি বাগেরহাট জেলায়। বিয়ে করেছেন নড়াইলের মহাজন এলাকায়। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় আট বছরের চাকরি জীবনে বাগেরহাট ও নড়াইলের মহাজন এলাকায় অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান।
অভিযোগের বিষয়ে ফিল্ড সুপারভাইজার ফাইজার রহমান বলেন, চাকরির জন্য কারো কাছে কোনো প্রকার টাকা দাবি করিনি। উঠান বৈঠকের টাকাও আত্মসাতের প্রশ্ন উঠে না। কারোর চাকরি খাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
অন্য দিকে উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা ঠিক নয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে আমার একার কোনো হাত নেই। অফিসিয়াল নিয়মানুযায়ী চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ইমাম সম্মেলনে ইমামদের সম্মানীর টাকা যাতায়াত ও খাওয়া খরচ বাবদ ব্যয় করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে জাকাত বাবদ ২০২৩ সালে এক হাজার এবং ২০২৪ সালে দুই হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement