১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ থেকে গ্রেফতার কয়েক শ’

-

- গাজায় ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে লাগবে ১৪ বছর : জাতিসঙ্ঘ
- নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি বিরোধী নেতার
- রাফায় আবারো ব্যাপক হামলা

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি আগ্রাসন অবসানের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েক দিন ধরে চলা এই বিক্ষোভ ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য। বৃহস্পতিবার বিক্ষোভে অংশ নেয়া শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে মার্কিন পুলিশ। বিবিসি ও আলজাজিরা।
বিবিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের কারণে ক্যালিফোর্নিয়ার শীর্ষস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠান বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া (ইউএসসি) শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমনে ‘নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ নেয়ার কথা জানিয়েছে। দেশটির কয়েক ডজন ক্যাম্পাস থেকে শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ মার্কিন প্রশাসনের ওপর চাপ তৈরি করছে।

বিবিসি বলছে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ থেকে চলে যেতে বাধ্য করতে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সাথে কর্তৃপক্ষের আলোচনা চলছে। গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রথম গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে সেখানে বিক্ষোভ করেন।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ বলেছে, শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে। ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় বৃহস্পতিবার আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৮ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ইমোরি পুলিশ বিভাগ বলেছে, বৃহস্পতিবার সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ স্থানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের প্রথমে ধাওয়া দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাসায়নিকের ব্যবহার করেছে বলে জানিয়েছে। তবে তারা বলেছে, পুলিশ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন ধরনের বস্তু ছোড়ার জবাবে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তারা বিক্ষোভে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভস্থল থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশকে ডাকার পর সেখানে নতুন করে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের পর নতুন করে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ‘গণহত্যা থেকে দূরে সরে যাওয়ার’ এবং গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের সমর্থনে অস্ত্র উৎপাদনে এবং অন্যান্য শিল্পের সাথে জড়িত সংস্থাগুলোতে বৃহৎ অর্থ বিনিয়োগ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। বর্তমানে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইল গণহত্যা পরিচালনা করছে অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। যদিও ইসরাইল এ অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ হিসেবে দাবি করে প্রত্যাখ্যান করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভের নেতৃত্বদানকারী চিসাতো মিমুরা বিবিসিকে বলেছেন, গাজায় গণহত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সরঞ্জাম সরবরাহ ও ইসরাইলে অর্থায়নের ঘটনায় আন্দোলনকারীরা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, ‘তারা যা করছে তা সম্পূর্ণরূপে এই গণহত্যার জন্য দায়ী। তারা যে ধরনের সুপরিচিত ভূমিকা পালন করছে, আমরা সেই বিষয়ে অবগত।’

বৃহস্পতিবার সকালের দিকে মিনিসোটার ডেমোক্র্যাট দলীয় কংগ্রেসউইমেন ইলহান ওমর ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেছেন। এর আগে গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভে যোগ দেয়া ইলহান ওমরের মেয়ে ইসরা হিরসিকে ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়ে দেয় পুলিশ। ইলহান ওমর বিবিসিকে বলেছেন, এ বিক্ষোভ মাত্র ৭০ জন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে শুরু হয়েছে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রথম অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে; যে কারণে বিক্ষোভ এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।’

গাজায় ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে লাগবে ১৪ বছর : জাতিসঙ্ঘ
গাজায় প্রায় সাত মাস ধরে চলা ইসরাইলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে অবিস্ফোরিত গোলাবারুদসহ বিপুল পরিমাণ ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করতে প্রায় ১৪ বছর সময় লাগতে পারে। শুক্রবার জাতিসঙ্ঘের মাইন অ্যাকশন সার্ভিসের (ইউএনএমএএস) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পেহর লোধাম্মার এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। গাজায় ইসরাইলের বর্বর হামলায় ২৩ লাখ মানুষের সঙ্কীর্ণ ও উপকূলীয় অঞ্চলটিকে মরুভূমিতে পরিণত করেছে। বর্তমানে সেখানকার বেশির ভাগ বেসামরিক মানুষ গৃহহীন, ক্ষুধার্ত এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। জেনেভায় এক ব্রিফিংয়ে পেহর লোধাম্মার বলেছেন, যুদ্ধের ফলে প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ টন ধ্বংসাবশেষ ব্যাপক ঘনবসতিপূর্ণ ওই অঞ্চলে পড়ে আছে। তিনি বলেন, গাজায় পাওয়া অবিস্ফোরিত গোলাবারুদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। তার পরও ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোর ধ্বংসাবশেষসহ পুরো ধ্বংসস্তূপ নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পরিষ্কার করতে ১৪ বছরের মতো সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের এই কর্মকর্তা বলেছেন, থ‘আমরা জানি, সাধারণত স্থল বাহিনীর ছোড়া গোলাবারুদের অন্তত ১০ শতাংশ অবিস্ফোরিত ও বিকল অবস্থায় থেকে যায়। আমরা ১০০টি ট্রাক ব্যবহার করে ১৪ বছর ধরে পরিষ্কার কাজ চালানোর কথা বলছি।’

নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি বিরোধী নেতার
আনাদোলু জানায়, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে নির্মূলের অজুহাতে অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। জবাবে ইসরাইলি সেনাদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে হামাসও। তবে প্রায় সাত মাস পরও হামাসকে পরাজিত করতে পারেনি ইসরাইল। এর মধ্যেই গাজায় ইসরাইলি সেনাদের হতাহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এমন অবস্থায় ‘ইসরাইলের নিরাপত্তার’ জন্য প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি করেছেন দেশটির বিরোধী নেতা ইয়ার লাপিদ।

ইসরাইলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি করেছেন। এ দাবিটি ইসরাইলের চ্যানেল ১২-এর খবরের প্রতিক্রিয়ায় সামনে এসেছে। ওই খবরে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, ইসরাইল সরকার আগামী ২০ মে পর্যন্ত হারেদিম নামে পরিচিত কট্টর-অর্থোডক্স ইহুদিদের নিয়োগসংক্রান্ত পিটিশনের ওপর সুপ্রিম কোর্টের রায় স্থগিত করতে চায়।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেয়া এক পোস্টে লাপিদ বলেন, ‘আর কত দিন অজুহাত দেখিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রকে কলঙ্কিত করতে থাকবে এই বিশৃঙ্খল সরকার? আইডিএফের (ইসরাইলি সেনাবাহিনী) কাছে যথেষ্ট সৈন্য নেই, এবং প্রত্যেককে তালিকাভুক্ত করতে হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ইসরাইলের নিরাপত্তার স্বার্থে নেতানিয়াহুর পদত্যাগ করা উচিত এবং এই সরকারকে আমাদের জীবন থেকে বের করে দেয়া উচিত।

হারেদিমকে সামরিক বাহিনীর চাকরি করা থেকে ছাড় দিয়ে যদি নতুন নিয়োগ আইন পাস না করা হয় তা হলে ক্ষমতাসীন জোটের ধর্মীয় দলগুলো সরকার থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। ইসরাইলের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ হারেদিম এবং তারা সামরিক বাহিনীতে কাজ করে না। এর পরিবর্তে তারা তাদের জীবন তাওরাত অধ্যয়নের জন্য উৎসর্গ করে থাকে।
অন্য দিকে আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের বেশি বয়সী প্রত্যেক ইসরাইলিকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। তবে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়া থেকে হারেদিমের অব্যাহতি কয়েক দশক ধরে ইসরাইলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরাইল আগ্রাসন চালাচ্ছে এবং তাদের আক্রমণের মধ্যে এ বিতর্কটি আরো তীব্র হয়েছে। ইসরাইলি সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে যারা ধর্মনিরপেক্ষ, তারা হারেদিমকে যুদ্ধের বোঝা ভাগ করে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

রাফায় আবারো ব্যাপক হামলা
গাজার রাফাহ শহরে আবারো ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। বৃহস্পতিবার সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি সেনারা। শহরটিতে আবার হামলা চালানোর সতর্কবার্তা দেয়ার এক দিন পরই এ হামলা চালাল তারা। এতে ব্যাপক হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই খবর জানিয়েছে।
বুধবার রাফাহ শহরে শিগগিরই অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছিল ইসরাইল। এর প্রস্তুতি হিসেবে সেখানে থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিল তারা। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে রাফাতে পাঁচটি বিমান হামলা হয়েছে। এ হামলায় কমপক্ষে তিনটি বাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় স্থানীয় এক সাংবাদিকসহ নিহত হয়েছেন অন্তত ছয়জন।
বৃহস্পতিবার রয়টার্সকে জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম খরাইশি বলেছেন, ‘রাফাতে যা ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অনেকেই পালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন তারা। তবে তারা যাবে কোথায়? উত্তর গাজায় যাওয়ার অনুমতি নেই তাদের। তারা একটি সঙ্কীর্ণ জায়গায় আটকে রয়েছেন।’


আরো সংবাদ



premium cement