১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পাবনার ঈদবাজারে ভারতীয় জামদানি শাড়ি কিনে প্রতারিত ক্রেতারা

পাবনার ঈদবাজারে ভারতীয় জামদানি শাড়ি কিনে প্রতারিত ক্রেতারা -


বাঙালি নারীদের একান্ত সঙ্গী শাড়ি। গুণগতমান ও নজরকাড়া সৌন্দর্যে সব বয়সী নারীদের কাছে জামদানি শাড়ি জনপ্রিয় বিভিন্ন উৎসবের চাহিদা বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে দেশী জামদানি শাড়ির চেয়ে ভারতীয় জামদানির চাহিদা বেশি। কারণ কম দামে একই ডিজাইনের শাড়ি পাওয়ায় ভারতীয় জামদানির চাহিদা বেড়েছে। পাবনা কাপড়ের দোকানগুলোতে যত জামদানি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে তার প্রায় ৭০ ভাগই ভারতীয় জামদানি শাড়ি। এই শাড়ি কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
পাবনা সদর, কাশিনাথপুর, আতাইকুলা ও শাহজাদপুর সরেজমিন ঘুরে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জামদানি শাড়িতে বাহারি রঙ, অপূর্ব নকশা আর সূক্ষ্ম বুননে রয়েছে ভিন্নতা। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে প্রতিটি শাড়ি যেন সেরা। সৌন্দর্যে একটি অন্যটিকে ছাড়িয়ে গেছে। আভিজাত্য, ঐতিহ্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে এ দেশের জামদানির তুলনা আর কিছুর সাথে হয় না বললেই চলে। ভিন্ন ভিন্ন নকশার শাড়ির রয়েছে সুন্দর সব নাম। দোকানিরা সাজিয়ে রেখেছেন নানা ভাবে। পাঁচ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার জামদানি শাড়ি রয়েছে। দুবলাজাল, বলিহার, ঝুমকা, কল্কাপাড়, বুটিদারসহ আরো বিভিন্ন নামের শাড়ি রয়েছে। বাহারি রঙ, নকশার নিম্নমানের এই শাড়িতে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাবনার এক শপিংমল মালিক বলেন, বর্তমানে দেশের বাজারে জামদানির চাহিদা কমেছে। উৎপাদন খরচ বেশি, মজুরিতে না পোষানোয় কারিগররা কাজে ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক তাঁত। দেশী শাড়ির চেয়ে ভারতীয় জামদানির দাম কম। তাই ব্যবসায়ীরা চোরাইপথে আসা ভারতীয় জামদানি শাড়ি নানাভাবে সংগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে। দোকানে যত শাড়ি বিক্রি হচ্ছে তার ৭০ ভাগই ভারতীয় শাড়ির।
পশ্চিমবাংলার আমদানি-রফতানিকারক অসিম চক্রবর্তী জানান, ভারতে জামদানি শাড়ি মেশিনে তৈরি হয়। তারা একদিনে দুই-তিনটি শাড়ি তৈরি করছে। উৎপাদন খরচ পড়ছে কম। সে জন্য ভারতীয় শাড়ির সাথে প্রতিযোগীতায় টিকতে পারছে না বাংলাদেশের হাতে তৈরি উন্নতমানের জামদানি শাড়ি। তিনি বলেন, বংলাদেশে তৈরি জামদানি মানের দিক থেকে যেমন সেরা, তাই দামও একটু বেশি। তবুও পশ্চিমবাংলার উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের পছন্দ বাংলাদেশের জামদানি। এছাড়া বাংলাদেশের সিল্ক জামদানি, হাফ সিল্ক জামদানি, সুতি জামদানি, কাতান, সুতি কাতান, রাজশাহী সিল্ক, বেনারসি, কটন শাড়ি টেকসই ও উন্নতমানের হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ভারতে।
আতাইকুলা হাটে ভারতীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভারতের পশ্চিমবাংলার উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কুচবিহার, হওড়া ও হুগলীসহ বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় নামীদামি শপিংমল ও বিপণিবিতানগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি জামদানিসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শাড়ি বিক্রি হয়। রমজানের ঈদ ও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সেখানে বাংলাদেশী শাড়ির বাজার জমে উঠেছে।

জামদানি কারখানার মালিক, মো: মোসলেহ উদ্দিন মোবাইলফোনে জানান, আমাদের দেশে তাঁত কারখানায় একটি জামদানি শাড়ি হাতে তৈরি করতে সময় লাগে কমপক্ষে সাত দিন। ফলে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। মানভেদে একেকটি শাড়ির দাম পড়ে পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। আর দেখতে প্রায় একই রকম ভারতের শাড়ির দাম মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। কখনো এর বেশি হয় না। সেজন্য ক্রেতারা ভারতের জামদানি কিনতে বেশি ঝুঁকছেন। কিন্তু ক্রেতারা মানটা দেখছেন না। তারা মনে করেন এটাও দেশী শাড়ির মতো সুন্দর হবে।
জামদানির কারিগর হাসমত উল্লাহ বলেন, জামদানি শাড়ি তৈরিতে সাধারণত ২৬, ৮০ ও ৮৪ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়। জামদানি টাঙ্গাইলসহ কয়েকটি এলাকায় তৈরি করা হয়। তবে ঢাকাকেই জামদানির আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। অপরূপ নকশা ফুটিয়ে তোলা হয় জামদানি শাড়িতে। জামদানি শাড়ি বাঙালি নারীদের অতি পরিচিত। মসলিনের ওপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। জামদানি দিয়ে নকশি ওড়না, থ্রিপিস, কুর্তা প্রভৃতি তৈরি করা হয়। এ ছাড়া জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানি তৈরি করা হয় বলে জানা গেছে।
জামদানি শাড়ি রঙ দিয়ে নকশা করা হয় না। তাঁতীদের কল্পনাকে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। নকশার কাজটি যেহেতু তাঁতীরাই করেন, সেখানে দেশের প্রকৃতির কথা থাকাটাই স্বাভাবিক। এ জন্য জামদানির নকশায় দেশীও ফুল, লতা-পাতার চিত্রই বেশি প্রাধান্য পায়। তবে জ্যামিতিক নকশা অনুযায়ী জামদানি নানা নামে পরিচিতি পায়। জামদানি শাড়িতে বুননের মাধ্যমেই নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। নকশা অনুযায়ী জামদানির নানা নাম হয়ে থাকে। যেমন- আঙ্গুরলতা, তেরছা, ময়ূরপাখা, কলমিলতা, বলিহার, জবাফুল ইত্যাদি।
জামদানি কারিগর হাসমত উল্লাহ জানান, প্রাথমিকভাবে জামদানি শাড়ির উপাদান অনুযায়ী এটি তিন প্রকার। হাফ সিল্ক জামদানি- যার সুতাগুলো হয় কটন আর লম্বালম্বি সুতাগুলো হয় রেশমের। ফুল কটন জামদানি- যা সম্পূর্ণ কটন (তুলা) সুতায় তৈরি। ফুল সিল্ক জামদানি-যা সম্পূর্ণ রেশম সুতায় তৈরি।
পাবনা সদর, কাশিনাথপুর, আতাইকুলা ও শাহজাদুরের কাপড় বিক্রেতারা বলেন, দেশী জামদানির সাথে কোনো শাড়ির তুলনা হয় না। অনেক ক্রেতার বাজেট কম থাকায় সে ভারতীয় জামদানি কিনছে। খুব কম মানুষ দেশী জামদানি ক্রয় করে। তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে ভারতীয় জামদানি পাওয়া যায়। যারা অরিজিনাল জামদানি চেনেন তারা কখনো আর্টিফিশিয়াল কেনেন না। সারা বিশ্বের মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই অরিজিনাল জামদানি তৈরি হয়। ভারত আমাদের দেশের শাড়ি নকল করে মেশিনে আর্টিফিশিয়াল জামদানি তৈরি করছে।


আরো সংবাদ



premium cement