১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বছরজুড়েই আলুর বাজারে টান থাকবে এবার!

আমদানি করে স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ
-


দেশে চালের পরে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের দিক থেকে এগিয়ে গোলআলু। আলুকে সবজি হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয় উল্লেখ না করলেও সাধারণ মানুষ এটিকে সারা বছর সবজি হিসেবেই খেয়ে থাকেন। এটি এমন একটি সবজি, যা মাছ, গোশত ও ডিমসহ নানাভাবে রান্না করে খাওয়া যায়। তাই আলুর ব্যবহারও সবচেয়ে বেশি। এটি এত দিন গরিবের সবজি হিসেবে থাকলেও বছরখানেক হলো এই আলুর বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে পরে। ভরা মৌসুমেও এবার আলুর বাজার লম্পঝম্প করেছে। ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে প্রতীয়মান হয় যে, এবার বছরজুড়েই আলুর টান (বাজার ঊর্ধ্বমুখী) থাকবে। ৫০ টাকা বা তারও বেশি দামে আলু কিনে খাওয়া লাগতে পারে ভোক্তাদের। যদিও সরকার ভারত থেকে আলু আমদানি করছে, তার পরও আলুর বাজার খুব বেশি নিম্নমুখী হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে আমদানি করে বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে সরকার।
সরকারি হিসাব বলছে, দেশে ৯০ লাখ টন আলুর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, এ বছর সাড়ে চার লাখ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি ১৬ লাখ টন। এর মধ্যে উচ্চফলনশীল আলু আবাদ করা হয়েছে তিন লাখ ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে। আর স্থানীয় আলু আবাদ করা হয়েছে ৫৬ হাজার ৫০৫ হেক্টর জমিতে। কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত নভেম্বরের শুরু থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আলু রোপণ করেন কৃষক। এর মধ্যে নভেম্বরে আগাম জাতের আবাদ করা হয়। অনেকে অক্টোবরের মাঝামাঝিতেও আবাদ করে থাকেন। এ আলু ৬৫-৭৫ দিনে পরিণত হয়। আর ডিসেম্বরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ে মূল মৌসুমের আলু রোপণ করে থাকেন কৃষক। সাধারণত পণ্যটি পরিণত হতে সময় লাগে ৯০ দিন। তবে এবার আলুর দাম গত বছর থেকেই উচ্চমূল্য হওয়ায় বেশি লাভের আশায় কৃষক অপরিণত অবস্থায় আলু তুলে বাজারজাত করেছেন। ছোট সাইজের আলু বাজারে বিক্রি করায় এবার উৎপাদনে বেশ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসিআই এগ্রোলিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. ফা হ আনসারী বলেন, ‘গত বছর সবজি বা অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম বেশি থাকায় মৌসুমের শুরুতেই আলুর ওপর চাপ বেশি ছিল। সে কারণে শুরুর দিকে আলুর ভোগ বেশি হয়েছে। এ বছর চ্যালেঞ্জিং বিষয় হলো দাম বেশি থাকায় কৃষকরা অনেকেই ছোট ছোট আলু তুলে ফেলেছেন। এতে উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ৯০ দিনের আলু কৃষকরা ৬০-৬৫ দিনে হারভেস্ট করে ফেলছেন। এক দিকে আলুর কনজাম্পশন বাড়ছে আবার উৎপাদন কমে গেলে সামনে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে আলুর উচ্চফলনশীল কিছু জাত এসেছে। কিন্তু এগুলোর সম্প্রসারণ এখনো সেভাবে হয়নি। এটি সম্প্রসারণ করতে হবে।’

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারক আহম্মেদ বলেন, ‘সাধারণত পরিণত আলু কেজিতে ৬-১০টি হয়। কিন্তু অপরিণত আলু ১৫-২০টিতে এক কেজি হয়। বাজারে ছোট সাইজের আলুই বেশি। দাম ভালো থাকায় আগে আগে তুলে ফেলছেন কৃষক। ১০-১২ টাকার আলু এখন ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কৃষকের জায়গা থেকে লাভ হচ্ছে। এটি এক দিক থেকে ভালো। কিন্তু দেশের সার্বিক উৎপাদন কিন্তু অনেক কমে যেতে পারে। মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাতে অনেকের আলু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপর আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে রোগবালাইও বাড়ছে। ফলে আলু নিয়ে একটি শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।’
জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে দেশে উৎপাদিত আলুর প্রায় ২৫ শতাংশ বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত অর্থবছরে দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে এক কোটি এক লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৮ লাখ ৮৭ হাজার ২৪২ টন আলু উৎপাদন হয়। সংশ্লিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী, উৎপাদন-পরবর্তী ক্ষতি বিবেচনায় নিলে প্রতি বছর দেশে প্রায় ২৬-২৭ লাখ টন আলু নষ্ট হয়ে যায়। সে হিসেবে দেশে আলুর চাহিদা ও উৎপাদনের ব্যবহারযোগ্য অংশ প্রায় কাছাকাছি।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘গত বছর কোল্ড স্টোরেজে যেসব আলু সংরক্ষণ করা হয়েছিল সেগুলো ৮-১২ টাকা কেজি দরের আলু ছিল। এবারে যেগুলো রাখা হচ্ছে সেগুলো ২৫-৩০ টাকায় কেনা আলু, কৃষকরা এবার এই দামে আলু বিক্রি করেছে। কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে এসব আলু যখন বাজারে আসবে তখন এর দামও বেশি হবে। তিনি দাবি করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগবালাইয়ের কারণে এ বছর অন্তত ২০ শতাংশ আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। একই সাথে সঙ্কট ও বাজার অস্থিরতার কারণে ভালো দাম পেয়ে কৃষক অন্তত ৩০ শতাংশ আলু তুলে বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। মুন্সীগঞ্জের কোল্ড স্টোরেজগুলোতে এ বছর ৩০ শতাংশ কম আলু সংরক্ষণ হয়েছে, ঠাকুরগাঁও, রংপুরের মত জায়গাগুলোতে ১০-২০ শতাংশ কম আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। যে কারণে এ বছর বেশি দাম দিয়ে আলু খেতে হবে।
রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রকারভেদে আলু ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর শেষে আলুর সঙ্কট তৈরি হলে দাম আরো ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, আলুর উৎপাদন কম হওয়ার কারণে এ বছর ৫০ টাকার বেশি দাম দিয়ে ভোক্তাদের আলু কিনে খেতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement