১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মুঘল আমলের স্থাপত্য গুরই শাহি মসজিদ

মুঘল আমলের স্থাপত্য গুরই শাহি মসজিদ -


১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ সাল, ৩৩১ বছর উপমহাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চলজুড়ে শাসন করে গেছে মুঘল শাসকগোষ্ঠী। ইতিহাসে সে সময়কার সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবেও খ্যাতির শীর্ষে ছিল মুঘলরা। বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কিছু অংশসহ আরো অনেক অঞ্চল ছিল তাদেরই দখলে। এ সময়কালে মুঘল শাসকরা, সাম্রাজ্যের পরিবর্তন, সংস্কৃতি, সামাজিক জীবন ও স্থাপত্যের উন্নয়নে তাদের রয়েছে অসাধারণ স্বাক্ষর। নির্মাণ করে গেছেন অনেক স্মৃতিসৌধ, মসজিদ ও দুর্গ। স্থাপত্যের স্বর্ণযুগে অবস্থান করে গেছেন মুঘল সাম্রাজ্যের অধিকাংশ শৈল্পিক মনের সম্রাট। এর সাক্ষ্য বহন করে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায় গুরই শাহি জামে মসজিদ। এই মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্যই বলছেন স্থানীয়রা। মসজিদের গায়ে লেখা ও নকশা থেকে মুঘল আমলের স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন ফুটে উঠেছে। মসজিদটিতে গম্বুজের গোড়ায় একটি সরু ও লম্বা শিলালিপি রয়েছে। সেখানে নির্মাণ সাল লেখা ১৬৮০। শিলালিপির নকশায় খোদাই করে লেখা আছে সুলতান বারবাক শাহ।

সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের ছেলে ও উত্তরাধিকারী ছিলেন রুকনউদ্দিন বারবাক শাহ (শাসনকাল ১৪৫৯-১৪৭৪)। বারবাক শাহ তার বাবার শাসনামলে সপ্তগ্রামের গভর্নর নিযুক্ত হন। বাবার মৃত্যুর পর ১৪৫৯ সালে তিনি ক্ষমতা লাভ করেন। তার নামানুসারেই গুরইয়ে ১৬৮০ সালে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক এই মসজিদের উৎপত্তি নিয়ে এখনো আলোচনার কোনো কমতি নেই। অতি প্রাচীন বলে এই মসজিদটিকে অনেকেই গায়েবি মসজিদ হিসেবেই মনে করেন। বিভিন্ন কারণ বিবেচনায় এই মসজিদে অনেকেই মানতও করেন। প্রবীণদের দেয়া তথ্য মতে, মসজিদটির চতুর্দিকে এক সময়ে জঙ্গলে ঘেরা ছিল। পরবর্তীতে যখন জঙ্গল পরিষ্কার করে মানুষের বসতি স্থাপন শুরু হয়, তখন হঠাৎ এই মসজিদটির দেখা মিলে। তাই এটিকে অনেকেই গায়েবি মসজিদই মনে করেন। গায়েবি মসজিদ নামেই এলাকাবাসী এটিকে চিনতেন। পরবর্তীতে যার সর্বশেষ নামকরণ করা হয় গুরুই শাহি জামে মসজিদ।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার গুরই ইউনিয়নে গিয়ে দেখা মিলে সেই ঐতিহাসিক মসজিদের। বর্তমানে এই মসজিদের পরিধি অনেকটা বেড়েছে। বর্গাকৃতির এই মসজিদের ভিতরের দিকের দেয়ালের উচ্চতা ২২ ফুট আর বাইরের দিকের দেয়ালের উচ্চতা ৩৫ ফুট বলে জানান স্থানীয়রা। চার কোণে চারটি অষ্টকোনাকৃতির মিনার রয়েছে, যা উপরে উঠে রৌপ্য নির্মিতব্যের ন্যায় ছোট গম্বুজ আকারে পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এছাড়াও লক্ষ্য করা যায় মসজিদটিতে একটি বাল্ব আকৃতির বড় গম্বুজেরও। উপরের গম্বুজের বিষয়ে স্থানীয় অনেকের ধারণা, এটি মূল্যবান পাথর দ্বারা তৈরি। মসজিদের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে প্রতিটি দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ ছিল। তবে বর্তমানে নিরাপত্তার লক্ষ্যে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। তিন রাস্তার মধ্যে পূর্ব সাইটের বা কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটি তুলনামূলক বড়। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের উচ্চতা ৭ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং প্রস্ত ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি মেহরাব। মধ্যবর্তী মেহরাবটি আকারে বড়। মেহরাবগুলোতে সুন্দর টেরাকাটার কাজও দেখতে পাওয়া যায়। এসব নির্দশনের মাধ্যমেই অনুমেয়, এটি সুলতানি আমলের স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের দেয়া তথ্য মতে, সাবেক জাতীয় সংসদের বিরোধী দল ‘কপ’ নেতা ও সংসদীয় পুলিশ উপকমিটির আহ্বায়ক ও দৈনিক গণশক্তির সম্পাদক ছিলেন খন্দকার মফিজুর রহমান রোকন। তিনি ১৯৮৮ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে এই মসজিদটি পরিদর্শনে আসেন। তখন তিনি পাথরে খোদাই করা আরবি হরফের লেখা থেকে অনুমান করেন, এটি মুঘল আমলের তৈরি মসজিদ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই মসজিদ পরিদর্শনেও আসেন অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান। বর্তমানে এই মসজিদে এক সাথে হাজারের কাছাকাছি মুসল্লি শুক্রবার দিন নামাজ আদায় করেন বলে দায়িত্বরতরা জানান। তাছাড়াও প্রতি ওয়াক্তে শতাধিক লোক এই মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করেন। এই মসজিদকে ঘিরে বর্তমানে গুরই ফয়জ আম হাফিজিয়া মাদরাসা ও গুরই ফয়েজ আম মহিলা মাদরাসা চালু আছে। এতে ছাত্রীর সংখ্যা ৩৫০ জন আর ছাত্রের সংখ্যা ২০০।
৭০ ঊর্ধ্ব স্থানীয় মুসল্লি ইস্রাফিল বলেন, এটি অত্যন্ত প্রাচীন একটি মসজিদ। বাপ-দাদার মুখে শোনেছি, এটি মুঘল আমলে তৈরি হয়ে থাকতে পারে। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ফাগুন মাসের প্রথম সপ্তাহে গ্রামে ওরস ও মেলা আয়োজন হয়।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান তোতা মিয়া বলেন, এই মসজিদের সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারেননি। তবে বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি, ১৮৬০ সালের দিকের মুঘল আমলে এটি তৈরি হয়ে থাকতে পারে। এছাড়াও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালে নিকলী-বাজিতপুরের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন খন্দকার মফিজুর রহমান রোকন। তখনকার সময় তিনি শিলালিপিতে সুলতান বারবাক শাহের নাম খোদাই করে লেখা দেখে বলেছিলেন এটি ১৮৬০ সালের দিকের নির্মিত প্রাচীন মসজিদ।


আরো সংবাদ



premium cement