ঈদ-বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাহারি নকশার শাড়ি তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলে
- ফরিদ মিয়া দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল)
- ২৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শাড়িতেই নারী, আর সেই শাড়ি যদি হয় টাঙ্গাইলের তাঁতিদের বানানো তাহলে তো আর কথাই নেই। আসন্ন ঈদ ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে নজড়কারা বাহারি ডিজাইনের শাড়ি
তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলের তাঁত পল্লীগুলোতে। পরে তা পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।
বর্তমানে জিআই পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িকে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। প্রাচীন কাল থেকেই টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা বংশ পর¤পরায় তৈরি করছেন এ শাড়ি। তা ছাড়া বিশ^খ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাংএর ভ্রমণ কাহিনীতে টাঙ্গাইলের বস্ত্র শিল্প অর্থাৎ তাঁত শিল্পের উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে তাঁতের শাড়ির জন্যই টাঙ্গাইলের সুনাম বা পরিচিতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বব্যাপী।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার তাঁতবহুল গ্রামগুলো হচ্ছে-ধুলটিয়া, বাজিতপুর, সুরুজ, বার্থা, বামনকুশিয়া, ঘারিন্দা, গোসাইজোয়াইর, তারটিয়া, এনায়েতপুর, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, কাগমারী প্রভৃতি। কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, ছাত্তিহাটি, আইসরা, রতনগঞ্জ কোবডোরা প্রভৃতি। দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলুয়া, দেওজান, নলশোঁধা, বিষ্ণুপুর গ্রামের তাঁত পল্লীতে তৈরি হচ্ছে এ শাড়ি।
এ ছাড়া গোপালপুর ও ভূঞাপুর উপজেলার কিছু কিছু গ্রামে তাঁত শিল্প আছে। এসব গ্রামের উৎপাদিত শাড়ি সদর উপজেলার বাজিতপুর ও করটিয়ার হাট থেকে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। বিশেষত দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল থেকে হাজার হাজার পিস শাড়ি রফতানিত হচ্ছে ভারতে। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি করতে হাতের কাজ করা হয় খুব দরদ দিয়ে, গভীর মনোযোগের সাথে অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও সুদৃশ্যভাবে। পুরুষরা তাঁত বোনে; আর চরকাকাটা ও তানাপারির কাজে সহযোগিতা করেন বাড়ির মহিলারা। তাঁতিরা মনের রঙ মিশিয়ে শাড়ির জমিনে শিল্প সম্মতভাবে তাঁত মেশিনের মাধ্যমে নানা ডিজাইন বা নকশা তৈরি করেন। বর্তমানে এর নকশা, বুনন ও রঙের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র্যতা এনেছে তাঁতিরা।
লিয়াকত, কাদির, আকবর, নামের কয়েকজন তাঁতি জানান, অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে গভীর মনযোগ দিয়ে শাড়ি তৈরি করা হয়। অন্যমনস্ক বা অদক্ষতা থাকলে শাড়ির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। ডিজাইন ভেদে একটি শাড়ি তৈরিতে ১ থেকে ২ দিন সময় লাগে। আবার প্রকার ভেদে কোনো জামদানি শাড়ি তৈরিতে তিন থেকে চার দিন সময় লেগে যায়। ডিজাইন অনুপাতে আমরা কোন শাড়িতে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত শ্রমিক মজুরি পেয়ে থাকি।
মমিনুর রহমান নামের এক তাঁতমালিক জানান, রঙ বেরঙের রেয়ন, জরি, ও উন্নত মানের মোলায়েম চিকন সুতার মাধ্যমে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি করা হয়। তবে আগের মতো শাড়ি এখন আর চলছে না। যার কারণে এ শিল্পে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। জেলার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে প্রথমে ভারতীয় শাড়ীর বাংলাদেশের বাজারে অবাধ প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
জেলা শহরের কয়েকটি বিপণী বিতান ঘুরে কয়েকজন মহিলা ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দাম একটু বেশি হলেও অত্যাধুনিক বাহারি ডিজাইনের শাড়ি কিনতে পেরে তারা বেজায় খুশি।
বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ডিজাইন, রঙ, হাতের কাজ ও সুতার গুণাগুণভেদে ৭০০, ১৪০০, ১৮০০ ও ২ হাজার’ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে তাঁতের শাড়ি।
হাফিজুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী জানান, টাঙ্গাইলের শাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো- কাপড়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুক্ষ্ম কারুকাজ।
এ শাড়ি তৈরি করার জন্য আমরা ১০০, ৮০, ৮২ ও ৮৪ কাউন্টের সূতা ব্যবহার করে থাকি। তবে ৮২ কাউন্টের সুতা বেশি ব্যবহার করা হয়। আর এবার ঈদ ও বৈশাখে আমাদের শাড়িগুলো ভালো বিক্রি হবে বলে প্রত্যাশা করছি। তা না হলে ব্যাংক এনজিওর দেনা শোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষত পশ্চিম বাংলায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ব্যাপক কদর রয়েছে। অন্যান্য শাড়ি ১০ হাত থেকে সর্বোচ্চ ১১ হাত মাপে তৈরি হয়ে থাকে, আর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি হয় ১৪ হাত মাপে। এ শাড়ি নরম মোলায়েম এবং পরতে আরাম, টেকেই অনেক দিন। এ ছাড়া সময় ও চাহিদার সাথে তাল রেখে দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ির আকর্ষণ ও নকশার ব্যঞ্জনা।
তবে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, সরকার এ শিল্পের উন্নয়নে কোনো নজর দিচ্ছে না। সুতার দাম দিন দিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সুতার দাম ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে তাল মিলিয়ে তারা শাড়ির দাম বাড়াতে পারছে না। যার ফলে এ ব্যবসা চলে গেছে সাধারণ তাঁতিদের কাছ থেকে বিত্তবানদের কাছে। যার ফলে গত ১০ বছরে প্রায় ৬০% তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। আর ঈদের পর বন্ধ হয়ে যাবে আরো অনেক তাঁত। অনেক ব্যবসায়ী এ শিল্প ছেড়ে দিয়ে কৃষিকাজ, থ্রী-পিসের ব্যবসা, প্রবাসজীবন ও গরুর খামারের কাজসহ বিভিন্ন পেশায় ঝুঁকে পড়েছেন। ভারতীয় চাকচিক্যের আড়ালে নিম্নমানের শাড়ী ও অন্যান্য পোষাক আমদানি বন্ধ করতে না পারলে এ শিল্প একদিন বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা। টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে তাঁতিদের সাথে কথা বলে সরকার প্রয়োনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করছেন এ পেশার সাথে সংশ্লিষ্টরা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা