০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`
চরম ভোগান্তিতে নগরবাসী

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা

গত বৃহস্পতিবার বৃষ্টির পর সৃষ্ট জলাবদ্ধতা রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গতকালও ছিল। ফলে পথচারীদের ভ্যান ও রিকশাই ছিল ভরসা : নয়া দিগন্ত -


বৃহস্পতিবার দিনে কয়েক দফা ভারী বৃষ্টিপাতের পর রাতেও মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়। এতে রাতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমে যায়। জলাবদ্ধতার কারণে রাতে বাসায় ফিরতি কর্মব্যস্ত মানুষকে দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকতে হয়। অনেকে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে যান। গতকাল শুক্রবারও বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে থাকতে দেখা যায়। নিউমার্কেট এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও মার্কেটের মধ্যে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্তও প্রায় হাঁটু পানি জমে ছিল। এতে ছুটির দিনে কেনাবেচা বন্ধ থাকায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া পুরান ঢাকা, আজিমপুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বুয়েট, গুলিস্তান, গ্রিন রোডসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক ও অলিগলিতে গতকালও জলাবদ্ধতা দেখা যায়। এসব সড়ক দিয়ে চলতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় স্থানীয় অধিবাসীদের।

রাতের বৃষ্টিতে রাজধানীর মালিবাগ, শান্তিনগর, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, ধানমন্ডি, মিরপুর ১৩, হাতিরঝিলের কিছু অংশ, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট যেতে নতুন রাস্তা, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, গুলশান লেকপাড় এলাকার সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। মিরপুর কমার্স কলেজের পাশে জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতের তার পড়ে পানি বিদ্যুতায়িত হয়। এ সময় সেদিক দিয়ে মিজান নামে এক ব্যক্তি তার স্ত্রী মুক্তা এবং সাত বছরের ছেলে হোসাইন ও ছয় মাসের শিশু লিনাকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তারা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনজনই ঘটনাস্থলে মারা যান। আর ছয় মাস বয়সী শিশু লিনা এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ সময় পাশে থাকা অনিক নামে এক রিকশাচালক তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এলে তিনিও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। এ ছাড়া রাত সাড়ে ৯টা থেকে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে একটানা বৃষ্টি ও বর্জ্রপাত হয়। এ সময় সড়কে পানি জমে যাওয়ায় বাসায় উদ্দেশে রওনা দেয়া কর্মব্যস্ত মানুষ পড়েন বিপাকে। হাঁটু পানির মধ্য দিয়ে হাঁটাও দুষ্কর হয়ে পড়ে। অনেক গাড়ি, সিএনজিও মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম বিপাকে পড়েন গাড়ির যাত্রীরা। জানযটের কারণে বাসায় ফিরতেও অনেকের গভীর রাত হয়ে যায়।

রাত ভর বৃষ্টির কারণে সড়কসহ অলিগলিতে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ড্রেন পরিষ্কার না থাকায় গতকাল বিকেল পর্যন্তও অনেক সড়ক ও অলিগলিতে পানি জমে থাকতে দেখা যায়। নিউমার্কেটে শুক্রবার ছুটির দিনে জমজমাট বেচাকেনা হয়। কিন্তু গতকাল মার্কেটে পানি জমে থাকার কারণে চরম বিপাকে পড়েন ক্রেতা-বিক্রেতারা। নিউমার্কেট ঘুরে দেখা যায়, মার্কেটের ভেতর-বাইরে এখনো কোমর সমান পানি। মিরপুর সড়কেও রয়েছে পানি। ঝিগাতলা থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত অংশে দুপুর পর্যন্তও পানি নামেনি। এ সময় দেখা যায় প্রায় প্রতিটি দোকানেই প্রবেশ করেছে বৃষ্টির পানি। নিচু দোকানগুলো প্রায় অর্ধেক অংশ পানির নিচে। নষ্ট হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মালামাল। নিউমার্কেটের দোকানি আসাদুর রহমান বলেন, শুক্রবার নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসার দিন। কিন্তু মার্কেটের আশপাশের এলাকা এখনো জলাবদ্ধ হয়ে আছে। দোকান খোলা তো দূরের কথা হাঁটাই যাচ্ছে না। পথচারীসহ অন্যদের পানির মধ্যে পা ডুবিয়ে চলতে হচ্ছে।

নিউমার্কেটের ভেতরের পানি অপসারণে গতকাল সন্ধ্যায় ‘সাকার’ মেশিন ব্যবহার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ওই মেশিন দিয়ে পানিনিষ্কাশনের লাইন পরিষ্কার করা হচ্ছে জানিয়ে ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, দিনভর মার্কেটের ভেতরে পানি থাকায় কোনো দোকানই খোলা সম্ভব হয়নি। তিনি আরো বলেন, বৃষ্টির পানি জমে শুধু নিউমার্কেটেই ৫০০ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে নিচতলার দোকানে পানি ঢুকে আসবাব ভিজে গেছে। কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তা ছাড়া শুক্রবার বেশি বিক্রি হয়। এই হিসাবে ক্ষতি আরো বেশি। জলাবদ্ধতার কারণ সম্পর্কে দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, জমে থাকা বৃষ্টির পানি অন্যান্য সময় দ্রুতই নেমে যায়। পানিনিষ্কাশনের মূল লাইনে হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে। এ কারণে ধীরগতিতে পানি নামছে। ২ নম্বর গেটে সেচপাম্প দিয়ে পানিনিষ্কাশনের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।

এ দিকে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে দেখা যায়, মার্কেটের ভেতরে পানি। সেচপাম্প দিয়ে পানি বিপণিবিতানের বাইরে ফেলা হচ্ছে। নিউমার্কেটের ভেতরে কোনো দোকান খোলা সম্ভব না হলেও ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের দোকানগুলো ধীরে ধীরে খোলা হচ্ছে। সেখানকার শাড়ি ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বলেন, যতবার বৃষ্টি হয়, মার্কেটের ভেতরে পানি জমে যায়। রাস্তা থেকে নিচু হওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানিনিষ্কাশনের জন্য তারা সেচপাম্প কিনেছেন বলেও জানান। মার্কেট আশপাশের রাস্তা থেকে নিচু হওয়ার পাশাপাশি পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো নয়। ড্রেনে ময়লা জমে থাকার কারণে পানিনিষ্কাশন ঠিকমতো হয় না বলেও জানান তিনি।

আজিমপুরে দেখা গেছে, নিউমার্কেট থেকে আজিমপুর সড়কে হাঁটু পানি। বিভিন্ন গলি, দোকানপাট ও বাসা বাড়ির নিচতলাতেও বাসিন্দারা পানি সরানোর চেষ্টা করছেন। তবে আশপাশের ড্রেনগুলোতে পানি জমে যাওয়াতে পানি সরানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংলগ্ন রাস্তায় দেখা যায়, মাঝে মাঝে যেন স্রোত বইছে। হলবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারো শিক্ষার্থী। অন্য দিকে বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ আশপাশের হলগুলোতে প্রবেশ করেছে বৃষ্টির পানি। শিক্ষার্থীরা আটকা পড়েছে হলে। ঢাকা কলেজ ঘুরে দেখা যায়-কলেজের হলের সামনে মাঝে মাঝে যেন স্রোত বইছে। পুকুর প্লাবিত হয়ে একাঠিক হলেও পানি প্রবেশ করেছে। এতে শিক্ষার্থীর ডাইনিং বন্ধ রয়েছে। হল বন্দী হয়ে পড়েছে হাজারো শিক্ষার্থী।

ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী বাঁধন বলেন, সব কিছু পানিতে একাকার। ডাইনিং বন্ধ। হলে পানি উঠেছে। বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। পুরো ক্যাম্পাস যেন পানি আর পানি। এসব পানিতে ময়লা ভাসছে। ভেসে রুমে, হলে ঢুকে পড়ছে। নিউমার্কেটের দোকানি শরিফুল ইসলাম বলেন, রাতে সব মাল উঁচু করে রেখে গেছি। সকালে এসে দেখি পানি আরো বেড়েছে। দোকানের ক্যাশ বাক্সসহ প্রায় অর্ধেক কাপড় পানিতে ভিজে গেছে। পাশের এক বই দোকানি জানায়, অন্তত এক হাজার বই ভিজে গেছে। যেন বন্যা হয়েছে নিউমার্কেটে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তিতুমীর, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও আবদুল মান্নান ও আহসানউল্লা হলে এখনো বৃষ্টির পানি আটকে আছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বৃষ্টিতে পাশাপাশি থাকা এই পাঁচ হলের নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ে। এতে অনেক শিক্ষার্থীর বই-খাতা ভিজে যায়। বুয়েটের তিতুমীর হলে বিকেলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা ভিজে যাওয়া বই-খাতা বারান্দায় শুকাতে দিয়েছেন। একটি কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, খাটের ওপরে টেবিল-চেয়ার তুলে সেখানে বইখাতা ও অন্যান্য জিনিস রাখা। হলের শিক্ষার্থীরা বলেন, গতকালের বৃষ্টিতে তাদের কক্ষে পানি উঠে যায়। তারা বই, খাতা ও অন্যান্য জিনিস মেঝে থেকে খাটে তুলে রাখেন। পরে রাতে তিনি দোতলায় এক বন্ধুর কক্ষে থাকেন। সকালেও যখন কক্ষে ফেরেন, তখনো পানি ছিল। এরপর তিনি হল থেকে বের হয়ে দুপুরের পর ফিরে আসেন। এসে আর কক্ষে পানি দেখেননি। তিতুমীর হলের নিরাপত্তাকর্মী আবদুল মান্নান বলেন, ২০০৬ সালের পর এবারই প্রথম নিচতলার বিভিন্ন কক্ষে পানি উঠেছে। এমনিতে বৃষ্টির পানি হল প্রাঙ্গণে কিছু সময় জমে থাকে। তবে গতকালের বৃষ্টির পানি এখনো জমে আছে। সরেজমিনে শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও আবদুল মান্নান হল প্রাঙ্গণে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। দুপুরের পরও বুয়েট এলাকার মসজিদের সামনের সড়ক ও আবাসিক এলাকায় হাঁটু পানি ছিল। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আবাসিক এলাকার নিচতলার ঘরগুলোতে ও পার্কিংয়ে পানি দেখা যায়।

লালবাগের ৮ নম্বর গলির বাসিন্দারা জানান, রাতের বৃষ্টির পর মধ্যরাতে তাদের গলি ভেসে বাসায় পানি আসতে শুরু করে। বিভিন্নভাবে পানি আটকানোর চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। বৃষ্টি থামার পর পানি অপসারণের জন্য ছোট বালতির মাধ্যমে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে মোটামুটি ঘরে ঢোকার ব্যবস্থা করা গেছে। একই এলাকার একজন মুদিদোকানি বলেন, রাতের বৃষ্টিতে দোকানে পানি ঢুকে অন্তত পাঁচ লাখ টাকার মালামাল ভিজে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও পানি সরাতে না পেরে অনেক মালামাল ফেলে দিতে হয়েছে।

বংশাল এলাকারা বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, বংশালের প্রধান সড়কসহ অলিগলি এখনো পানিতে ডুবে আছে। অলিগলির ময়লা-আবর্জনা পানির সাথে মিশে দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। বংশাল পার হওয়ার সময় প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটু পানি মাড়িয়ে আসতে হয়েছে।
মিরপুরের কুর্মিটোলা পূর্ব বিহারি ক্যাম্পের দেখা যায়, ভেতরে কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমর পানি। ক্যাম্পের বেশির ভাগ ঘরেই পানি জমে রয়েছে। এই অবস্থায় ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দা চৌকি বা খাটের ওপর অবস্থান নিয়ে দিন পার করছেন। তারা রাতে ঘুমাতে পারেননি। কোনোমতে রাত পার করেছেন। কিন্তু এখনো ঘরে পানি জমে আছে। ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলেন, ভারী বৃষ্টি থেমে যাওয়ার ১২ ঘণ্টার বেশি সময় পার হলেও পানি নামছে না। ক্যাম্পের পাশের খালটি ভরাট করায় পানি সরছে না। ফলে রাত থেকে তাদের চরম ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। ঘরের তোশক-বালিশসহ সব ভিজে গেছে। ঘরে পানি জমে থাকায় রান্নাবান্না করা যাচ্ছে না। যাদের ঘরে শিশু আছে, তাদের দুর্ভোগ আরো বেশি। ক্যাম্প প্রতিনিধি মো: ফিরোজ বলেন, পাশেই একটি খাল ছিল। বৃষ্টি হলে এই খাল দিয়ে পানি নেমে যেত। কিন্তু সম্প্রতি খালটি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তাই একটু বৃষ্টি হলেই ক্যাম্পে পানি জমে যায়।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, রাত থেকেই তাদের কুইক রেসপন্স টিম মাঠে কাজ করছেন। এ ছাড়া শুক্রবার সাধারণ ছুটি হলেও তারা তাদের কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করেছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জনসংযোগ বিভাগ কোথাও পানি জমে থাকলে ১৬১০৬ নম্বরে নগরবাসীকে ফোন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সমস্যার সমাধানে দুই সিটি করপোরেশনই নগরবাসীর সাহায্য চেয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement