২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঝিমুনি রোগে আক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ মেগাপ্রকল্প

ঝিমুনি রোগে আক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ মেগাপ্রকল্প -


-৭ বছরে রূপপুরের অগ্রগতি ৫৫.৫৯ শতাংশ
-১৩ বছরে দোহাজারী থেকে গুনদুম রেলপথ ৮৪ শতাংশ
-৯ বছরে মহেশখালীর মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো ৭৫.৭০ শতাংশ
-৭ বছরে পদ্মা সেতুতে রেললাইন ৭৫ শতাংশ
-মেট্রো রেল-৬ লাইন সাড়ে ১০ বছরে ৭৫ শতাংশ

ঝিমুনি রোগে আক্রান্ত হয়েছে দেশে ফাস্ট ট্র্যাক বা শীর্ষ মেগাপ্রকল্পগুলো। একমাত্র স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ দ্রুত গতিতে সমাপ্ত হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পই মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। প্রায় সাত বছরে মাত্র ৫৫.৫৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে সর্বোচ্চ ব্যয়ের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি। আর ৮৪ শতাংশ ভৌত কাজ করতেই দোহাজারী থেকে রামু, কক্সবাজার হয়ে গুনদুম পর্যন্ত রেলপথ প্রকল্পের প্রায় ১৩ বছর শেষ। সাড়ে সাত বছর সময়ে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ এবং প্রায় আট বছরে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৯.৩৫ শতাংশ। পদ্মা সেতু বাদে ফাস্ট ট্রাকের সাত প্রকল্পে গত এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে এক লাখ ৬৪ হাজার ৮১৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। এই প্রকল্পগুলোর জন্য অনুমোদিত খরচ হলো তিন লাখ ৬ হাজার ২৬৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা বলে ফাস্ট ট্র্যাকের রিপোর্টের তথ্য থেকে জানা গেছে। অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণে ফাস্ট ট্র্যাকের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে অগ্রগতি প্রত্যাশিত নয়।

ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের সর্বশেষ এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতির তথ্য থেকে জানা গেছে, সবচেয়ে ব্যয়বহুল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া থেকে ঋণ নেয়া হয়। গত ২০১৬ সালের জুলাইতে প্রকল্পটি শুরু হয়ে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৫৫.৫৯ শতাংশ। আর ব্যয় হয়েছে ৫৩ শতাংশ বা ৫৯ হাজার ৯৪৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এখানে রাশিয়ার ঋণ হলো ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। চলতি এডিপিতে প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ কমে এখন ১৩ হাজার ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আগামী ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করা কথা।

এই তালিকায় রয়েছে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন রেলের ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটির এক যুগের বেশি সময়ে অগ্রগতি ৮৪ শতাংশ। প্রকল্পটি ২০১০ সালের জুলাইতে শুরু। আর ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১২ বছর ১০ মাসে খরচ হয়েছে ৪২ দশমিক ৩৯ শতাংশ অর্থাৎ ৭ হাজার ৪০২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদেশী ঋণ ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ২০১০ সালের জুনে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে এখন আগামী ২০২৪ সালের জুনে সমাপ্ত করার কথা রয়েছে।
পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেললাইন স্থাপনের জন্য নেয়া প্রকল্পটি কাজ হয়েছে এপ্রিল পর্যন্ত সাত বছর চার মাসে ৭৫ শতাংশ। ওই অগ্রগতিতে খরচ হয়েছে ৭০ দশমিক ৯৭ শতাংশ বা ২৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকার বৈদেশিক ঋণসহ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনুমোদিত খরচ ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত করে রেল চলাচল শুরু করার কথা। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এই প্রকল্পটির মেয়াদ শুরু হয়।

আর মহেশখালীর-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম। এখানে ১২ শ’ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্পসহ মোট ১২টি প্রকল্প রয়েছে। এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত আট বছর ১০ মাসে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৭৫.৭০ শতাংশ। আর অর্থ ব্যয় হয়েছে ৬০ দশমিক ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ ৩১ হাজার ৪২৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ রয়েছে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে এখন আগামী ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উন্নীত করা হয়েছে।

রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও যানজট কমাতে নেয়া ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের বা মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। তবে অর্থ ব্যয় হয়েছে ১০ বছর ১০ মাসে ২১ হাজার ৬৭২ কোটি ২৩৬ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৬৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এই প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। পরে বাড়িয়ে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা করা হয়েছে। বিদেশী ঋণ হলো ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটি ২০১২ সালের জুলাইতে অনুমোদন নিয়ে শুরু করে। প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান। বর্তমানে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রেললাইন চলমান আছে। প্রতিদিনই যাত্রীরা এই অংশের সুফল পাচ্ছে। আগামী ২০২৪ সালের জুনে সমাপ্ত করার কথা। সরকার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত লাইন চালু করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।

দেশের অন্যতম তৃতীয় গভীর সমুদ্র বন্দর পায়রা বন্দরের ভৌত কাজ এপ্রিল পর্যন্ত হয়েছে ৮৯.৩৫ শতাংশ। এই পর্যন্ত অগ্রগতিতে সময় লেগেছে সাত বছর ১০ মাস। ২০১৫ সালের জুলাইতে আরম্ভ হওয়া এই প্রকল্পটি গত ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময় বাড়িয়ে এটাকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। সন্দেহ এই বছরও শেষ হবে না। প্রায় ৮ বছরে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৬২৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৮২.৮৯ শতাংশ। প্রকল্প খরচের পুরো চার হাজার ৩৭৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা সরকারি অর্থায়ন।
এ দিকে এডিপিভুক্ত নয় তবে ফাস্ট ট্র্র্যাকের তালিকার আরেকটি প্রকল্প রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের ভৌত কাজের অগ্রগতি এপ্রিল পর্যন্ত ৯১.৭২ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি ৮৭.৮৯ শতাংশ। প্রকল্পের ব্যয় ১৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত ৬ বছরে ১৪ হাজার ৬৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সমাপ্ত করার কথা ছিল। প্রকল্পটির আওতায় বাগেরহাটের রামপালে একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বিশ্লেষণ হলো, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর এবং তাদের কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণেই গুরুত্বপূর্ণ এই সব মেগা প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে নির্ধারিত সময়ে শেষ না হলে সময় বাড়লে ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, ভালো কাজের জন্য কোনো পুরস্কার এবং খারাপ কাজ বা কাজের অবহেলার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে। দেশের মানুষও সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement