২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক : মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা

-

১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ কার্যক্রম শুরু করা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার সফল অগ্রযাত্রার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠানটি তার সাফল্য ও অগ্রগতির ৪০ বছর অতিক্রম করেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে একের পর এক সাফল্যের মধ্য দিয়ে আজ দেশের ব্যাংকিং খাতে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে ইসলামী ব্যাংক। আমানত, বিনিয়োগ, আমদানি-রফতানি, রেমিট্যান্স আহরণ, শিল্পায়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ মার্কেট শেয়ার ধারণ করে ইসলামী ব্যাংক জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম শক্তি অর্জন করেছে। এ ব্যাংকের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এখন দেশে ১০টি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিংসহ প্রায় তিন ডজন ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইনডোর মাধ্যমে পরিচালনা করছে। সার্বিকভাবে দেশের মোট ব্যাংকিংয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে, যার হিস্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। এই অগ্রযাত্রার অন্তর্নিহিত বিষয়, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নয়া দিগন্তের কাছে তুলে ধরেছেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নয়া দিগন্তের প্রধান প্রতিবেদক ও বিশেষ সংবাদদাতা আশরাফুল ইসলাম।
প্রশ্ন : ইসলামী ব্যাংকের গত ৪০ বছরের উল্লেখযোগ্য অর্জন কী?
মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা : প্রথম কথা হলো, ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেম দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করানোর বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এটি ব্যাংকিং খাতের একটি নতুন সিস্টেম ছিল। এই নতুন সিস্টেম দেশের মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি যে সুপিরিয়র সিস্টেম তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয় হলো আমাদের ব্যাংকের গ্রহণযোগ্যতা সব জায়গায় পৌঁছাতে ইসলামী ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মার্কেট শেয়ার যদি বিবেচনা করা হয়, তা হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের আমানতের ১০ শতাংশের বেশি ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে। এটি মূলত ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের যে আগ্রহ সেই আগ্রহের জায়গা থেকেই এটি সম্ভব হয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবেই কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হলো ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার জন্য উপযোগী যে জনশক্তি দরকার তার ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যারা বের হচ্ছেন তারা প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য লেখাপড়া করে আসছেন। ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য তারা ওইভাবে তৈরি হয় না। এ কারণে নতুন এ প্রজন্মকে প্রচুর প্রশিক্ষণের আওতায় এনে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত আমাদের ব্যাংকিং শিল্পকে পুরোপুরি দু’টি ভিন্ন ধারায় পরিচালিত করি। অন্যান্য ব্যাংকের সাথে আমাদের যে মৌলিক পার্থক্য এটি তো অবশ্যই সুদ ও মুনাফার বিষয় আছে। এর অতিরিক্ত আমরা রিয়েল ট্রানজেকশন করি অর্থনীতিতে। আমাদের প্রতিটি বিনিয়োগ একটি সম্পদের বিপরীতে করা হয়, সে কারণে এটি রিয়েল ইকোনমিতে ভালো ভূমিকা রাখে।
এখন যে বিষয়টি আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় তা হলো, এখনো কিন্তু ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার জন্য আলাদা আইন হয়নি, একটা গাইড লাইনের মাধ্যমে আমরা ব্যাংকিং করছি। এই গাইড লাইনের তো কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আর সীমাবদ্ধতাটাকে ওভারকাম করার জন্য ব্যাংকিং শিল্পে ইসলামী ব্যাংকিং ধারা পরিচালনার জন্য ইসলামী ব্যাংক আইন করা এ মুহূর্তে সময়ের দাবি বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন : সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ঋণের নামে টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। যেসব ঋণের বিষয়ে কথা উঠেছে তা আদায় হয়েছে কি না। আর এ ধরনের ঋণ আবার দেয়া হচ্ছে কি না?
মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা : ইসলামী ব্যাংকের তিনটি অ্যাকাউন্ট নিয়ে রিপোর্ট হয়েছিল। সম্পদভিত্তিতে আমরা বিনিয়োগ করি, তাই যে পণ্যটি আমদানি করা হয় তার সাথে বিক্রির একটি সম্পর্ক রয়েছে। যার কারণে পণ্য বিক্রয়ের অর্থ আসতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে তা সমন্বয় হয়ে যায়। তিনটি অ্যাকাউন্টের মধ্যে একটি অ্যাকাউন্ট এভাবে ইতোমধ্যে সমন্বয় হয়ে গেছে। আর দু’টি অ্যাকাউন্ট মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই সমন্বয় হয়ে যাবে বলে আমি আশা করি। স্বাভাবিকভাবে এটি যদি আমাদের ভুল বলেন, আমরা ভুল সংশোধন করতে প্রস্তুত রয়েছি। একটি বিশেষ ও জাতীয় প্রয়োজনে আমরা এ বিনিয়োগ করেছিলাম, এখন আমরা অতিপ্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া এ ধরনের আর কোনো বিনিয়োগ করছি না।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ইসলামী ব্যাংকের জমি বিক্রি করা হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু যদি বলেন?
মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা : টাকার জন্য ইসলামী ব্যাংকের জমি বিক্রি করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এ জমি আমরা কিনে ছিলাম ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় স্থাপনের জন্য। এটা কেনা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক কেপিআই হওয়ার আগে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেপিআই হওয়ার কারণে আমাদের যে ধরনের ভবন তৈরি করার জন্য প্রয়োজন ছিল তার অনুমোদন আমরা পাচ্ছিলাম না। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ জমি কেনার জন্য আমরা প্রস্তাব করেছিলাম। এ প্রক্রিয়া কিন্তু সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই এটি আমাদের ব্যাটেবলে হয়নি। জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেকগুলো বিভাগ প্রধান কার্যালয়ের পাশে সেনাকল্যাণ ভবনে স্থানান্তর হয়েছে। বর্তমান গভর্নর এসে নিজেদের একটি জায়গা খুঁজতে ছিলেন। এখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আমাদের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। কেপিআইয়ের কারণে আমরা যেহেতু নিজেরা পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে পারছি না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ জায়গা ব্যবহার করতে পারে বলে আমরা মনে করেছি। আর এ কারণেই এ জায়গাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া মেট্রোরেলও কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করেছে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের (ওবিইউ) মাধ্যমে যে ঋণ নেয়া হয় তা একক ঋণগ্রহীতার সীমার মধ্যে থেকে করার কথা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থা কী?
মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা : আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত অনুসরণ করি। একক ঋণগ্রহীতার সীমার মধ্যে আমাদের কিছু বিনিয়োগ ছিল। তা সমন্বয় করা হচ্ছে।
প্রশ্ন : বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সঙ্কটের কারণ কী এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা : তারল্য সঙ্কট প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীব্যাপী হয়ে গেছে। প্রতিটি দেশে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। আমাদের যেটা ৮৫ টাকা ছিল, তা ১১০ টাকা হয়ে গেছে। একই ব্যবসা পরিচালনায় আগে যেখানে এক লাখ টাকা লাগত, এখন তা তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা হয়ে গেছে। এখানে তারল্য সঙ্কটের কিছু বিষয় আছে। এ ছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাতকে কোনো না কোনোভাবে আঘাত করা হয়েছে। কিছু দিন আগের একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এক লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা মানুষের হাতে আছে। আগে যেখানে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ছিল। এটির প্রধান কারণ হলো মানুষ ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা কিছুটা হারিয়ে ফেলেছিল। এই টাকাটা ফিরিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে মানুষের হাতে যে টাকা রয়েছে, তা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় বিষয়। তারল্য সঙ্কটের এটিই মূল কারণ। এ থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করে আমাদের গ্রাহকের কাছে তা বার্তা হিসেবে পৌঁছাতে হবে যে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর এখন সুশৃঙ্খল। অনেকটা ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। এটি হলে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ হওয়া সম্ভব হবে।
প্রশ্ন : এ মুহূর্তে ইসলামী ব্যাংকের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আপনি কোন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা : আমাদের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে সারা দেশের ব্যাংকিং খাতের মতো আমরাও কিছুটা আস্থার সঙ্কটে ছিলাম। এটি ওভারকাম করার জন্য আমাদের যে কোর ডিপোজিটার আছে তাদের সহযোগিতা নিচ্ছি। ইনশা আল্লাহ আমরা অনেক দূর কভার করে ফেলেছি। অন্য দিকে গত এক বছরে আমাদের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মতো আমানত প্রত্যাহার হয়েছিল। আমাদের এখন মূল লক্ষ্য হলো, প্রত্যাহার হওয়া আমানত ফিরিয়ে আনা। সে জন্য আমরা কাজ করছি। এটি আনা গেলে ইনশা আল্লাহ আমাদের সমস্যাগুলো কেটে যাবে। আমি আশা করছি এটি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
প্রশ্ন : ইসলামী ব্যাংকের অনেক কোর গ্রাহক অভিযোগ করছে তাদেরকে এলসি খুলতে দেয়া হচ্ছে না। ডলার সঙ্কট না অন্য কোনো কারণ আছে?
মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা : এ সঙ্কট শুধু ইসলামী ব্যাংক না, সব ধরনের ব্যাংকেরই একই অবস্থা। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক তো একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। আমরা ৭০ শতাংশ সার আমদানি করেছি। এখনো এ সারের দায় ডলারে পেমেন্ট দিতে হচ্ছে। আমরা যদি সময়মতো সার আমদানির জন্য এলসি না খুলতাম, তা হলে সার আমদানি করা সম্ভব হতো না। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। সেই কাজটি আমরা জাতীয় দায়িত্ব বলেই মনে করেছি। বর্তমানে যে সঙ্কট রয়েছে তা আমরা ধীরে ধীরে রেমিট্যান্স আহরণ ও রফতানি আয়ের মাধ্যমে ওভারকাম করব ইনশা আল্লাহ।
প্রশ্ন : আগামী ৫ বছরে ইসলামী ব্যাংককে কোন অবস্থানে দেখতে চান?
মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা : ইসলামী ব্যাংক প্রথম ব্যাংক যেটি বিশ্বের এক হাজার ব্যাংকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমরা বর্তমানে ৮৮২তম অবস্থানে আছি। সম্পদ ও বিভিন্ন আার্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এটি করা হয়। আমার ইচ্ছে হলো, ইসলামী ব্যাংককে আগামী ৫ বছরে শীর্ষ ১০০ ব্যাংকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই আমরা চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ।


আরো সংবাদ



premium cement