২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সুরমার খনন নিয়ে রশি টানাটানি

চার প্রকল্পের একটিও দেখেনি আলোর মুখ
-

প্রায় দেড় যুগ পর আবার বন্যার কবলে পড়ে সিলেট। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সুরমার দুই তীর ছাপিয়ে ডুবিয়ে দেয় নগরী। এই দুর্ভোগের জন্য সুরমার নাব্য সঙ্কটকেই দায়ী করছেন সিটি মেয়র। এ অবস্থায় নদী খনন পরিকল্পনার কথা বলছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে কে কাজ করবে এই নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে চলছে রশি টানাটানি।
এ দিকে চলমান বন্যার পর ফের আলোচনায় এসেছে এই অঞ্চলের প্রধান নদী সুরমা খননের বিষয়টি। দীর্ঘদিন নদী খনন না হওয়ায় বেশি ভুগতে হচ্ছে নগর ও সুরমাতীরবর্তী মানুষদের। এজন্য সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এবার বন্যার পর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন সুরমা নদী খনন করা হবে।
সম্প্রতি বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি আটকে থাকছে। এই নদী খনন করতে হবে। আগামী বর্ষার আগেই নদী খনন করা হবে উল্লেখ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিলেটের নদীগুলো খননের পরিকল্পনা নিয়েছি। তবে এখনো নদী খনন প্রকল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না পাওয়ায় বর্ষার আগে আদৌ নদী খনন সম্ভব হবে কিনাÑ এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
খনন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, সুরমা নদী এক দিনে ভরাট হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে পলি জমে এটি এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। আরো আগেই এই নদী খননের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে নদী খননের প্রকল্পই পাস হয়নি। সরকারি প্রকল্পে যে জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, তাতে প্রকল্প পাস হয়ে কাজ শুরু হতেই বছর পেরিয়ে যায়। ফলে আগামী বর্ষার আগে খননকাজ শেষ হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবু আমরা চাই, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই যেন খননকাজ শুরু হয়।
আলোর মুখ দেখেনি চার প্রকল্প : ১০ বছরে সিলেটের প্রধান নদী সুরমা খননে চারটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রস্তাবনাগুলো (ডিপিপি) পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। এরপর তিনবার সমীক্ষা চালানো হলেও এখন কোনো প্রকল্পই আলোর মুখ দেখেনি। সবশেষ ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ড্রেজিং বিভাগ সুরমা খননে তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেটিও এখন পর্যন্ত পাস হয়নি। এরও আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সুরমা খননে তিনটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে সুরমা নদী খননে সর্বপ্রথম একটি প্রকল্প নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পাউবোর সিলেট কার্যালয় থেকে এই প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রস্তাবের পর নদী খননে সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষার পর নদী খননে উদ্যোগ নেয়ার কথা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানোও হয়েছিল। এরই মধ্যে ছয় বছর চলে গেলেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এরপর ২০১৭ সালে ৩০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প পাঠায় পাউবো। আর ২০১৯ সালে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খনন, বাঁধ নির্মাণ ও নদীর তীর প্রতিরক্ষার জন্য ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি ডিপিপি পাঠায় পাউবো। সেবারও সমীক্ষা চালানো হয়। তবে সমীক্ষায়ই আটকে যায় কার্যক্রম। আবার ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সুরমা খননে তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ওই বছর চালানো হয় সমীক্ষা। এই প্রকল্পও মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে।
এ দিকে পাউবোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, সুরমা ও কুশিয়ারা ভারত থেকে উৎপত্তি হয়েছে। সুরমার প্রথম ২৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত লাইন দিয়ে গেছে। ফলে উৎসমুখ থেকে খননের জন্য যৌথ নদী কমিশন থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। যৌথ নদী খনন করতে হলে দুই দেশের সম্মতি ও চুক্তির প্রয়োজন হয়। ভারতের সাথে চুক্তি না হওয়ায় এত দিন আটকে ছিল এই নদী খনন। তবে সম্প্রতি যৌথ নদী প্রটেকশনের আওতায় ভারতের সাথে চুক্তি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন, নদী খননে আমরা তিনটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকল্পগুলো পাস হয়নি। আর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) ছাইদুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা তিন হাজারের কিছু বেশি টাকার একটি প্রকল্প জমা দিয়েছিলাম। অনেক দিন আগেই এটি পরিকল্পনা কমিশনে জমা হয়েছিল। তবে এখনো পাস হয়নি।
বিআইডব্লিউটিএ-পাউবোর টানাটানি : সুরমা নদী খনন না করায় ভুগতে হচ্ছে সিলেট নগর ও সুরমাতীরবর্তী মানুষদের। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়রা খননের দাবি জানালেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে চলমান বন্যার পর ফের আলোচনায় আসে সুরমা খননের বিষয়টি। এ অবস্থায় নদী খননে পরিকল্পনার কথা বলছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে কে খননকাজ করবে এ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে চলছে রশি টানাটানি।
নদীর উৎসমুখ ভরাট : সুরমার দুই রূপ। বর্ষায় দুকোল উপচে ডুবিয়ে দেয় জনবসতি। আর গ্রীষ্মে পানি শুকিয়ে পরিণত হয় মরা গাঙে। জেগে উঠে চর। প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুরমা সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এই নদী বছরের বেশির ভাগ সময় থাকে পানিহীন। পলি জমে ভরাট হয়ে পড়েছে নদীর তলদেশ। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা হয়ে পড়ে বালুভূমি। অপর দিকে অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় বন্যা। বৃষ্টিতে নদীর পানি উপচে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য মতে, সুরমার উৎসমুখই ভরাট হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে এ নদীর উৎসমুখের ৩২ কিলোমিটারে শতাধিক চর জেগে উঠে। বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম নয়া দিগন্তকে বলেন, উজান থেকে ঢলের সাথে বালু ও পলি নামে। তাই নিচের দিক খননের চেয়ে উজানে খনন করা বেশি জরুরি। কেবল উৎসমুখই নয়, ঢলের সাথে আসা বালুও পলিতে ভরাট হয়ে গেছে প্রায় পুরো সুরমা নদী। শুষ্ক মৌসুমে জকিগঞ্জ থেকে সিলেট পর্যন্ত নদীতে শতাধিক স্থানে জেগে ওঠে চর।
দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, কানাইঘাট, টুকেরবাজারসহ কয়েকটি স্থানে নদীর জেগে ওঠা চরে শুষ্ক মৌসুমে সবজি চাষও করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ সময় বন্ধ হয়ে যায় নৌযান চলাচল। প্রায় পুরো নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ২০১৮ সালে সুনামগঞ্জের কিছু অংশ খনন করা হলেও তাতে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।


আরো সংবাদ



premium cement