২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজধানীতে প্রতিদিন জমে ৬ হাজার টন পলিবর্জ্য

২০ বছরে ব্যবহার বেড়েছে বিশগুণ
-

কিছুতে থামানো যাচ্ছে না পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার। নিষিদ্ধ পলিথিনে ছেয়ে গেছে দেশ। ২০ বছর আগে পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন নিষদ্ধ হলেও এখনো পলিথিনের ব্যবহার ও উৎপাদন অব্যাহত আছে। সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হলো নিষিদ্ধের পর এর ব্যবহার না কমে উল্টো তা বিশ গুণ বেড়েছে। এখন ঢাকা শহরে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন পরিবেশ ও মানুষ রক্ষায় দ্রুত পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে রাজধানীসহ সারা দেশে মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। বিশেষ করে মুদি সামগ্রী ও কাঁচাবাজার পরিবহনে পলিথিনের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো।
অভিযান পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশজুড়ে পলিথিন তৈরির প্রায় এক হাজারেরও বেশি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে টঙ্গী, কামরাঙ্গীরচর, পুরান ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, নারায়ণগঞ্জে এগুলো অবস্থিত।
বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) বলছে, পলিথিনের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ৫০ লাখ বেড়ে গেছে। যে পরিমাণ পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে তাতে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন এর বর্জ্য উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচ হাজার ৯৯৬ টন। এ ছাড়া পলিথিন নিষিদ্ধের পর গত প্রায় দেড় যুগে সারা দেশে জনপ্রতি পলিথিনের ব্যবহার ৭ কেজি বেড়েছে।
পলিথিনের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব এ নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা এবং সামাজিকভাবে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি না করলে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ তৈরি হয়। পলিথিন নিষিদ্ধের পর গত বিশ বছরে এর ব্যবহার বেড়েছে বিশ গুণ। তিনি বলেন, ৭৮ বছর আগে আবিষ্কৃৃত পলিথিনের কোনটাই এখনো ধ্বংস হয়নি। কারণ পলিথিনের লাইফ টাইম হলো ২০০ বছরের কাছাকাছি। ফলে পলিথিনে মাটি পানি ও বায়ু ভয়াবহ দূষণ হয়। আমরা রাজধানীর ধানমন্ডি লেকের ও বুড়িগঙ্গার মাছের পেটে প্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছি। এগুলো খাদ্যের মাধ্যমে আমাদের শরীরেও প্রবেশ করছে। বর্তমানে ক্যান্সারের রোগী বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এই প্লাস্টিক। তিনি বলেন, পলিথিন শুধু ব্যাগ নয় বোতল, প্লেট, গ্লাস খাবারের প্যাকেটসহ বিভিন্নভাবে উৎপাদন হচ্ছে। এগুলো শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে বন্ধ করে শহরে জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। যেমন ঘটেছে সিলেটে। সেখানে ড্রেনের পানি নিষ্কাশন নষ্ট করার সাথে নদীর নাব্যতা ধ্বংস করেছে প্লাস্টিক। যার কারণে পানিতে শহর তলিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে যখন তৎকালীন সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করে, তখন তারা মানুষের হাতে এর বিকল্প কিছু দিতে পারেনি। ফলে তা বন্ধ করা যায়নি। ফলে আইনের ফাঁকে নিষিদ্ধের পরও পলিথিন উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। মানুষের হাতে পলিথিনের বিকল্প সহজলভ্য কাপড় বা কাগজের অর্থাৎ পচনশীল সামগ্রী দিয়ে তৈরি ব্যাগের প্রচলনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে তার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তর করতে হবে পলিথিন পরিহারের আন্দোলনকে।
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (প্রশাসন-৩) মো: রফিকুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করণীয় ঠিক করে এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়েও প্লাস্টিক পণ্য বিশেষ করে পানির বোতল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এতদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসা প্লাস্টিক চাইলেই সহজে বন্ধ করা যায় না। সরকারি ও সামাজিক নানান উদ্যোগের মাধ্যমে তার বন্ধের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকারী পরিবেশ অধিদফতরের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (সিনিয়র সহকারী সচিব) নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, ঢাকার চকবাজার, ইসলামপুর, টঙ্গী নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে পলিথিন কারখানায় প্রচুর ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, অভিযান পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা বলছে, বাজারে ব্যাগের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ফলে পলিথিনের বিকল্প না থাকায় মানুষ পলিথিন ব্যবহার করছে। যার কারণে তার ব্যবহার ও উৎপাদন বাড়ছে। তারপরও আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। এরই মধ্যে রাজধানীর বড়ো বড়ো শপিংমল ও সুপারশপগুলোতে পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ ব্যবহারের মাধ্যমে পলিথিন ব্যবহার কমেছে। এভাবে পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ তৈরি করলে তার ব্যবহার কমে আসবে।
অন্যদিকে পরিবেশ অধিদফতরের পদবি উপপরিচালক (বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবস্থাপনা) ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, পরিবেশ অধিদফতরের কার্যক্রমের পরও পলিথিন বন্ধ হয়নি এটা সত্য। তবে আমরা সাধ্যমতো কাজ করেও শতভাগ সফল হতে না পারা থেকে শিক্ষা নিয়েছি। সে অনুযায়ী কার্যক্রম আরো শক্তিশালী করতে নানান কার্যক্রমের সাথে দশ বছরব্যাপী কার্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে আলাদা কমিটি থাকবে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থাও সহায়তা করবে। কারণ আমরা চাই বিগত সময়ের ভুলগুলো শুধরে শতভাগ সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে।
সেভ দ্য এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্টের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, কেনো কিছু নিষিদ্ধের আগে তার বিকল্প রাখতে হবে। পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও তার বিকল্প ব্যবহারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে এ বিষয়ে আইনের প্রয়োগ যথাযথ হবে না। তাই সরকারের উচিত এর শতভাগ সফলতা পেতে পচনশীল বিকল্প ব্যাগের ব্যবস্থা করা।


আরো সংবাদ



premium cement