০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

গ্যাসের চেয়ে এলএনজি ২৪ গুণ ব্যয়বহুল

প্রতি কিউবিক মিটারে ভর্তুকি ২৭ টাকা
- ছবি - সংগৃহীত

স্থানীয়ভাবে গ্যাসের চেয়ে আমদানিকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ২৪ গুণ বেশি ব্যয়বহুল। সরকার বিদেশ থেকে চড়া দামে এই গ্যাস কিনে অত্যন্ত কম দামে স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সরবরাহ করায় প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি প্রদান করতে হচ্ছে। এই ভর্তুকির অর্থ আবার দেশের কর দেয়া জনগণের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। যেমন ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার বিদেশ থেকে প্রতি কিউবিক মিটার এলএনজি ৩১ টাকা ৫৬ পয়সায় আমদানি করে তা স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা করে বিক্রি করে। এর ফলে ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রতি কিউবিক মিটারে ২৭ টাকা ৮ পয়সা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’ (সিপিডি) গতকাল রোববার আয়োজিত ‘জ্বালানি সরবরাহে গ্যাস-এলএনজি বিতর্ক : বিদ্যুৎ খাতের জন্য এলএনজি আমদানির ব্যয় এবং প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট আবদুল্লাহ ফাহাদ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা পূরণে এলএনজির ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। কিন্তু এলএনজি এক ধরনের অনিশ্চিত জ্বালানি পণ্য। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম যেভাবে বাড়ছে, এতে খুব শিগগিরই এর দাম কমবে না। অন্য দিকে বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, এলএনজির আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীরা দীর্ঘ মেয়াদে স্থির মূল্যের চুক্তিতে আগ্রহী নয়। পাশাপাশি আঞ্চলিকভাবে গ্যাসের মূল্য একীভূত হচ্ছে, যার ফলে এলএনজি রফতানি কম লাভজনক হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও বিকল্প পরিচ্ছন্ন (ক্লিন) শক্তির উৎস সন্ধান করতে হবে এবং অভ্যন্তরীণ গ্যাসের মজুদ থেকে গ্যাস সরবরাহের ওপর জোর দিতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের জন্য প্রতি ইউনিট এলএনজির যে আমদানি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে ২৪ গুণ বেশি। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি ঘনমিটার এলএনজির দাম ছিল ৩১ টাকা ৫৬ পয়সা। এর বিপরীতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রতি ঘনমিটারে দিয়েছে মাত্র ৪ টাকা ৪৫ পয়সা। এটা সরকারের ওপর বোঝা। এমতাবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এলএনজি আমদানির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিদ্যমান পদ্ধতি পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।

সিপিডির মতে, নতুন এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন (পাইপলাইনে ৬,৪৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১১টি প্ল্যান্ট) যৌক্তিক নয়। স্বল্প মেয়াদে এলএনজি আমদানির সুপারিশ করে সংস্থাটি বলেছে, তাৎক্ষণিকভাবে চাহিদা-সরবরাহের ব্যবধান মেটাতে বিশেষত গৃহস্থালি, শিল্প, হোটেল রেস্তোরাঁ, পরিবহন ইত্যাদি খাতে আমদানিকৃত এলএনজি ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে জ্বালানি সরবরাহে ঐতিহাসিকভাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাধান্য রয়েছে যদিও গত দশকের শেষের দিকে স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন কমতে শুরু করে। অনুমান অনুযায়ী অবশিষ্ট গ্যাস রিজার্ভ (১০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট) ধীরে ধীরে (২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন এক-তৃতীয়াংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে শূন্য) হ্রাস পাবে। তবুও জ্বালানি সরবরাহের অবকাঠামো প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে গ্যাসের ঘাটতি চাহিদার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। স্থানীয় উৎপাদনের তুলনায় ক্রমবর্ধমান চাহিদা হারের কারণে ২০২৩-২৪ সালে এই ব্যবধান সর্বোচ্চ হবে। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ম. তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমামও বক্তব্য রাখেন।

গ্যাসের দাম বাড়াতে গণশুনানি শুরু ২১ মার্চ : বিতরণ কোম্পানিগুলোর গ্রাহকপর্যায়ে গ্যাসের মূল্য ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি শুরু হবে ২১ মার্চ থেকে। চলবে ২৪ মার্চ পর্যন্ত। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। এ সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তি শিগগিরই দেবে কমিশন। বিইআরসি বিতরণ কোম্পানিগুলোর মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব আমলে নিলে দুই চুলায় ব্যয় ৯৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ২১০০ টাকা এবং এক চুলায় ৯২৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০০০ টাকা হবে।

জানা গেছে, গত জানুয়ারিতে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের খুচরা মূল্য ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর জন্য বিইআরসির কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিল। এতে রান্নার জন্য দুই চুলার সংযোগে ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা এবং এক চুলার ব্যয় ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রায় একই হারে আবাসিকের প্রিপেইড মিটার, শিল্প, সিএনজি, বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ গ্যাসের দামও বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। প্রস্তাব অনুসারে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় দাম ৯ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বেড়ে ২০ টাকা ৩৫ পয়সা হবে। শিল্পে প্রতি ঘনমিটারের দাম ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩ টাকা ২৪ পয়সা এবং ক্যাপটিভে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সার স্থলে ৩০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে।

কোম্পানিগুলো থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর তা যাচাই-বাছাই করতে কমিশন একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। কমিটি ছয় বিতরণ কোম্পানি, একটি সঞ্চালন কোম্পানি ও পেট্রোবাংলার প্রস্তাব আমলে নিয়ে তা যাচাই-বাছাই করছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, এলএনজি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গ্যাসে ভর্তুকি বেড়ে গেছে। এই চাপ সামলাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জুলাই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। আবাসিক খাতে দুই চুলার খরচ ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা বৃদ্ধি পায়। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, ক্যাটপিভ পাওয়ার, শিল্প ও চা বাগানে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম গড়ে ৩২.০৮ শতাংশ বাড়ে।

গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট। দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে এখন পাওয়া যাচ্ছে ২৩৩ কোটি ঘনফুট। বঙ্গোপসাগরে থাকা দু’টি ভাসমান এলএনজি প্রক্রিয়াকরণ টার্মিনালের মাধ্যমে পাওয়া যায় ৬০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে বিদ্যুতে ব্যবহƒত হয় ৬৮.৩৭ শতাংশ, সারে ৯.৩৯ শতাংশ, ক্যাপটিভে ৫.৯২ শতাংশ, শিল্পে ৭.০৬ শতাংশ, হোটেল, রেস্টুরেন্টে ০.২৩ শতাংশ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ০.২৮ শতাংশ, সিএনজিতে ৩.০৭ শতাংশ, বাসা-বাড়িতে ৫.০১ শতাংশ এবং চা বাগানে ০.৬৭ শতাংশ গ্যাস ব্যবহƒত হয়।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল