২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এক দিকে সঙ্কট, অন্য দিকে বেকার ২৫ হাজার মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট

-

দেশে করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চলছেই, টানা তৃতীয় দিনের মতো গত ২৪ ঘণ্টায় (২৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত) দৈনিক ১৫ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে, শনাক্তের হারও ৩০ শতাংশের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন শনাক্ত রোগী ১৫ হাজার ৮০৭ জন। এর আগের দুই দিন, অর্থাৎ বুধবার ও মঙ্গলবারে যথাক্রমে ১৫ হাজার ৫২৭ ও ১৬ হাজার ৩৩ জন রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিল অধিদফতর। বাংলা ট্রিবিউন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের করোনার নমুনা পরীক্ষা করানোর হার বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যত মানুষ টেস্ট করাতে চান, তাদের অনেকে কেবল সরকারি পরীক্ষায় ভোগান্তি আর বেসরকারিতে উচ্চ ফির কারণে বিরত থাকছেন। আর যারা বয়স্ক কিংবা অন্য কোনো সমস্যায় পড়ে সরকারিভাবে টেস্ট করাতে বাসায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সুবিধা নিতে চান, তারা তা সময় মতো পাচ্ছেন না। আবার কেউ নমুনা দিতে পারলেও সময় মতো রিপোর্ট পাচ্ছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র বলছে, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে। তাদের বড় একটা অংশই বাসায় ডাকছেন স্যাম্পল কালেকশনের জন্য। কিন্তু তার জন্য যে পরিমাণ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট দরকার, তার অনেক কম জনবল দিয়ে হোম স্যাম্পল সংগ্রহ করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট বলেন, জনবল কম হওয়ার কারণে তাদের একেকজনকে দ্বিগুণ, কখনো তারো বেশি কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু তাতেও দিনের কাজ দিনে শেষ করা যাচ্ছে না। নমুনা সংগ্রহের জন্য অনেক বাসাতেই তারা নির্ধারিত দিনে যেতে পারছেন না। অথচ দেশে এখন প্রায় ২৫ হাজারের মতো মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট বেকার বসে আছেন। তাদের কাজে লাগাতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। গত দুই বছরের মহামারীতে প্রতিবার যখন সংক্রমণের ঢেউ আসে তখন সেটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। এমনিতেই সঙ্কট রয়েছে, সেইসাথে প্রতিটি ল্যাবে একাধিক টেকনোলজিস্ট করোনাতে আক্রান্ত হয়ে যখন আইসোলেশনে যায় তখন সেই সঙ্কটের তীব্রতা হয় ভয়ঙ্কর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে পাঁচজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে। সে হিসেবে দেশে এখন প্রয়োজন এক লাখের বেশি টেকনোলজিস্ট। কিন্তু বাংলাদেশ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে টেকনোলজিস্টের পদ রয়েছে মাত্র সাত হাজার ৯২০টি, কর্মরত আছেন পাঁচ হাজার ১৬৫ জন। এর মধ্যে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি) পদ দুই হাজার ১৮২টি। আর কাজ করছেন এক হাজার ৪১৭ জন।
দীর্ঘ ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত থাকায় মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের ঘাটতি ছিল। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের বিষয়টি আবার সামনে আসে। করোনার নমুনা সংগ্রহ ও ল্যাবরেটরি বাড়ানোর ফলে সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করায় মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের দাবি ওঠে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক ২০২০ সালের ২৯ জুন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের ৮৮৯টি, মেডিক্যাল টেকনিশিয়ানদের এক হাজার ৬৫০টি, কার্ডিওগ্রাফার পদে ১৫০ জনসহ দুই হাজার ৬৮৯টি পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
পরে লিখিত পরীক্ষায় ২৩ হাজার ৫২২ জন অংশ নিয়ে উত্তীর্ণের মধ্যে থেকে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় পরের বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেই নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর দুই হাজার ৮০০ পদের সেই নিয়োগ বাতিল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতর নতুন এক অফিস নির্দেশনায় জানায়, ২০ সেপ্টেম্বরের নির্দেশনার আলোকে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে চলমান জনবল নিয়োগের কার্যক্রম বাতিল করা হলো। পুনরায় নতুন নিয়োগে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। ইতঃপূর্বে যারা আবেদন করেছেন, তাদের নতুনভাবে আবেদনের প্রয়োজন নেই; তারা নতুন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। পরে সে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল চেয়ে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়।
দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষা হওয়া একাধিক হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগগুলো বলছে, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের অভাবে তারা ঠিকমতো নমুনা পরীক্ষা ও সময় মতো পরীক্ষার রিপোর্ট দেয়া যাচ্ছে না। যা কি না এই ঊর্ধ্বগতির সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।
যখন নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম থাকে তখন অসুবিধা হয় না জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: নুসরাত সুলতানা বলেন, কিন্তু যখন এ রকম ঊর্ধ্বগতি হয় তখন খুব সমস্যা হয়ে যায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের স্যাম্পল প্রসিডিউর অন্যান্য জায়গার তুলনায় ভিন্ন রকম জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে অনেক স্পট রয়েছে স্যাম্পল কালেকশনের জন্য। যেমন চিকিৎসকদের জন্য, নার্সসহ টেকনোলজিস্টদের জন্য, বহির্বিভাগ, বার্ন ইউনিট, কোভিড এবং নন-কোভিড ইউনিটের মতো পৃথক জায়গায় স্যাম্পল কালেকশনের জন্য টেকনিশিয়ানরা গিয়ে থাকেন।
আর বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে একটি জায়গাতেই ৪০ থেকে ৫০টি নমুনা নিতে হয়। কিন্তু একজনের পক্ষে সীমিত সময়ের মধ্যে এত নমুনা নেয়া আসলেই খুব কঠিন।
আবার ল্যাবের ভেতরেও চিকিৎসকরা সাংঘাতিক সঙ্কটময় সময় পার করছে মন্তব্য করে ডা: নুসরাত সুলতানা বলেন, ‘স্যাম্পল আনার পর থেকে পুরো প্রসেসিংয়ে চিকিৎসকদের সাহায্য করার মতো টেকনোলজিস্টের খুবই অভাব। তারা নমুনা নেবে নাকি ভেতরে কাজ করবে? এই মুহূর্তে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের ল্যাবে ডেপুটেশন, দিনভিত্তিক চুক্তিসহ বিভিন্নভাবে নিয়োগ করা ১৩ জনের মতো কাজ করছেন, যেখানে এখন দরকার নিদেনপক্ষে ২০ জন। তারাও রোস্টারভিত্তিক কাজ করে। আর যখন কেউ করোনায় আক্রান্ত হন, তিনি আইসোলেশনে চলে যান; তখন পরিস্থিতি আরো সঙ্কটপূর্ণ হয়ে ওঠে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: জাহিদুর রহমান বলেন, ‘করোনাকালে ফ্রন্টলাইনার হচ্ছেন নার্স আর মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টরা। কারণ তারাই রোগীর সংস্পর্শে বেশি যান। তাই তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে।
তার নিজের ল্যাবে করা ব্যক্তিগত এক গবেষণার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের মধ্যেই আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। অনেকেই একবার থেকে একাধিকবার, এমনকি তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছেন। গত এক সপ্তাহেই আমার ল্যাবে তিনজন টেকনিশিয়ান পজিটিভ হয়েছে, তাদের কাজগুলো কিভাবে হবে, কে করবে?’
স্বাভাবিক সময়ে কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নেয়া গেলেও সংক্রমণের যখন ঊর্ধ্বগতি হয়, তখন পরিস্থিতি খুবই সঙ্কটময় আর কঠিন হয়ে পড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক দিকে কাজের চাপ বাড়ে, আরেক দিকে লোক কমে যায়।
দেশে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না জানিয়ে ডা: জাহিদুর রহমান বলেন, করোনার কারণে সে প্রক্রিয়া শুরু হলেও দুর্নীতির কারণে সেটা বাতিল হয়ে গেল। তবে একটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। আগে থেকেই সঙ্কট; তার ওপর হাজার হাজার টেকনোলজিস্ট পাস করে বসে আছে, অথচ এই কঠিন সময়ে তাদেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
বেকার অ্যান্ড প্রাইভেট সার্ভিসেস মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে যেভাবে টেস্ট দরকার এই করোনার সময়ে, সেভাবে কখনোই টেস্ট হয়নি। আর এর একমাত্র কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের অভাব। সঙ্কট আগে থেকে থাকলেও করোনা আসার পর তার প্রয়োজনীয়তা চোখের সামনে আসে। এরপর আমাদের আন্দোলনের কারণে এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এক হাজার ২০০ পদ তৈরি করা হয়। কিন্তু পরীক্ষাসহ সবকিছুর পর দুর্নীতির কারণে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। অথচ করোনা মোকাবেলা করার জন্যই বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে পদ তৈরি করে, নিয়োগ পরীক্ষা হয়। বলা হয়েছিল দ্রুততম সময়ে পরে আবার সার্কুলার দেয়া হবে, কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। অথচ প্রায় ২৫ হাজার টেকনোলজিস্ট বেকার বসে রয়েছে। তাদের অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে হলেও পরে পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দেয়া যায়।
মেডিক্যাল টেকনোলিজস্ট নিয়োগ না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা: ইহতেশামুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, করোনা মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দেয়া হলেও মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ না দেয়াটা খুবই হতাশার কথা। অথচ তারাই নমুনা পরীক্ষা থেকে শুরু করে ল্যাবের ভেতরেও কাজ করে থাকেন। বর্তমান সময়ে এই সঙ্কট প্রখর হয়ে উঠেছে। হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা করা যাচ্ছে না ঠিকমতো, রিপোর্ট পাচ্ছে না মানুষ। খুব দ্রুত এর সমাধান হওয়া উচিত।


আরো সংবাদ



premium cement
বিএনপি ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : ওবায়দুল কাদের মাটির নিচে পাওয়া গ্রেনেড মাইন মর্টার শেল নিষ্ক্রিয় করল সেনাবাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছে জবি, বন্ধ থাকবে পরীক্ষা কুড়িগ্রামে রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দেওয়ানগঞ্জের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিহাব কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ সাতক্ষীরা বৈদ্যুতিক খুটিতে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী নিহত বার্সেলোনাতেই থাকছেন জাভি চতুর্থ দফা ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি : এবারের তাপদাহ শেষেই বৃষ্টিপাতের আশা ফরিদপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজে হাজারো মুসুল্লির কান্না পোরশার নোচনাহারে আগুনে ৩টি দোকান পুড়ে গেছে

সকল