২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসি আইন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সংসদে

কাউকে ইনডেমনিটি দেয়া হয়নি : আইনমন্ত্রী
-

নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে গতকাল। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কয়েকজন এমপি বিলটি জনমত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব তুললে তা নাকচ হয়ে যায়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে ইসি আইন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের সংসদ সদস্যরা।
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য। স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রপতি কোনো কাজ করতে পারেন না। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে একটি ইল্যুশন হিসেবে সামনে আনা হয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করেছিল। তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি ছিল। এখন সে ঘাটতি আরো অনেক বেড়েছে। জাতীয় থেকে স্থানীয় সব নির্বাচন মাগুরার নির্বাচনের চেয়ে অনেক খারাপ হয়। সুতরাং ’৯৬ সালের চেয়ে এখন তত্ত্বাবধাক সরকার আরো বেশি দরকার। বিএনপির সংরক্ষিত আসনের এমপি রুমিন ফারহানা বলেন, আদালত বলেছিল সংসদ চাইলে আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সংবিধান সংশোধন কমিটিতে সব দল এই ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিল। পরে অজানা কারণে এটি বাতিল করা হয়। এখন যে পরিস্থিতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনই সম্ভব না। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে জাতীয় পার্টিকে। এটি একটি অসাংবিধানিক ফর্মুলা। তিনি বলেন, সঠিকভাবে নির্বাচন না হওয়ার কারণে বিশ্বের অনেক দেশে গৃহযুদ্ধ হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ইসি গঠনে সংবিধানে আইন করার কথা বলা আছে, কিন্তু অংশীজনের সাথে কথা না বলে তাড়াহুড়ো করে আইন করা আইওয়াশ ছাড়া কিছুই নয়। এ আইনটি কেবল বিএনপি নয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা কঠোর সমালোচনা করেছেন। এটাকে ইসি গঠনের আইন না বলে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আইন বলা যেতে পারে। তিনি বলেন, সার্চ কমিটিতে সরকারি দল, সংসদের প্রধান বিরোধী দল ও তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন করে প্রতিনিধি থাকলে স্বচ্ছতা থাকত। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে কেবল সরকারের ইচ্ছায় ইসি গঠন হবে। ওই কমিশন স্বাধীন হবে না, হবে সরকারের নির্বাচনবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নির্বাচিত বিএনপির হারুনুর রশীদ একটি নির্বাচন কমিশন আইন গঠনের দাবি জানিয়ে বলেন, সংবিধানে বলা আছে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব ইসিকে সহায়তা করা। কিন্তু না করলে কী হবে তা বলা নেই। এসব নিয়ে একটি পুরো আইন হওয়া উচিত। এই আইনটিকে সরকারের কূটকৌশল আখ্যা দিয়ে হারুন বলেন, ২০১৪ সালে বিনাভোটের নির্বাচন হয়েছে, ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে আগামীতে দিনের বেলা নতুন কৌশলে নির্বাচন করবে কি না, তা নিয়ে মানুষের প্রশ্ন আছে। এখন যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাতে নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
হারুনুর রশিদ বলেন, জনগণ মনে করে সরকার আইন করার নামে তাদের সাথে প্রহসন করছে। এ আইনটির সাথে ২০১৭ সালের সার্চ কমিটির প্রজ্ঞাপনে খুব একটা অমিল নেই। কোনো আইনে মানুষের অকল্যাণে হলে তা করার থেকে না করাই ভালো। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সার্চ কমিটির দায়িত্ব দেয়া হলে তাদেরও বিতর্কিত করা হবে। এই আইনে জনগণ হতাশ। তারা এটা চায় না। তাদের দাবি প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৫-৯৬ ও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিলেন তারা সেটা চায়। অবশ্যই নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। প্রমাণ করতে পারবেন না গত দুটি কমিশন জনগণকে আস্থাশীল করতে পেরেছে। তাই বলব নির্বাচন কমিশনের নামে নাটক-প্রহসন বাদ দিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার দ্বার উন্মোচন করুন। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব- আপনি উদ্যোগ নিন। সব রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বসে নির্বাচনকালীন সময়ে কিভাবে নির্বাচনটি করবেন সেটা ঠিক করুন। সরকারে থাকতে একরকম বক্তব্য আর বিরোধী লে গেলে অন্যরকম বক্তব্য ঠিক নয়।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, বিএনপি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তারা একটি অস্বাভাবিক সরকার আনতে চায়। তাদের সংসদ সদস্যরা এখানে সংশোধনী প্রস্তাব দিলেও এরই মধ্যে নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি নেতারা। তিনি বলেন, বিএনপি বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মানে কিনা, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা, যুদ্ধাপরাধ, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এসব মানে কি না স্পষ্ট করতে হবে। এসব না মানলে এই যুদ্ধ বন্ধ হবে না। ইনু বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছুতোয় বিএনপি একটি অস্বাভাবিক সরকার গঠন করতে চায়। অনুসন্ধান কমিটি যে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবেন তাদের নাম ঠিক করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি অনুসন্ধান কমিটিকে কোনো পরামর্শ দিতে পারবেন না।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, এর আগে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, আইনটি করার জন্য সময় প্রয়োজন। এই আইনটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। তিনি নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। এ ছাড়া অনুসন্ধান কমিটি যে নামগুলো দেবে সেগুলো জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। বলেন, এটা হলে তা অনেক ইনক্লুসিভ হবে। এ ছাড়া অনুসন্ধান কমিটি যে নামগুলো প্রস্তাব করবে সেগুলো অন্তত প্রকাশ করা এবং এরপর জনমত বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন এ ব্যবস্থা করারও দাবি জানান মেনন।
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা নেই। এই ইসির সুবিধাভোগী ছাড়া সবাই বলবে তারা ব্যর্থ। কমিশনের সরকারের আকাক্সক্ষার বাইরে কিছু করতে পারে না। তিনি বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপে গিয়ে যে আইন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি এ আইনে তার প্রতিফলন ঘটেনি। আইনটি বঙ্গবন্ধুর আকাক্সক্ষার সাথে অবাস্তব।
জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম আইনে প্রস্তাবিত সার্চ কমিটির সদস্য নির্বাচনের সংসদ সদস্যদের ভূমিকা রাখার বিধান যুক্ত করার দাবি করেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন শতভাগ আমলানির্ভর উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বাংলাদেশে কী বিচারপতি ও আমলা ছাড়া বিশ্বাস করার মতো কেউ নেই? রাজনীতিবিদ বা সংসদ সদস্যদের কী বিশ্বাস করা যায় না? আওয়ামী লীগ এত বড় রাজনৈতিক দল, বলেন আপনাদের জন্ম ক্যান্টনমেন্টে জন্ম হয়নি তাহলে আপনারাও কেন বিচারপতি ও আমলার ওপর নির্ভর করবেন? চুন্নু তার বক্তব্যে স্পিকারের মাধ্যমে মনোনয়নে দু’জন সংসদ সদস্যকে সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে রাখার প্রস্তাব করেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সংসদে পাস হওয়া ইসি গঠন আইনে কাউকে ইনডেমনিটি দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ ইনডেমনিটির ওই পথে হাঁটে না। ইনডেমনিটি কথা শুনলেই আওয়ামী লীগের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বিএনপি ইনডেমনিটি দিয়ে আমাদের রক্তক্ষরণ করিয়েছে। এ আইনে লিগ্যাল কাভারেজ দেয়া হয়েছে। এই আইনে কেউ অন্যায় করে থাকলে তাকে প্রকেটশন দেয়া হয়নি। তড়িগড়ি করে আইন পাস প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি এটি তড়িঘড়ি করে করার আইন নয়, এটি সত্য। বর্তমান কমিশনের মেয়াদের মধ্যে আইন করা সম্ভব নয় এটাও বলেছি। কারণ আমি বলেছিলাম করোনার সময় যে সীমিত সময়ের জন্য সংসদ বসে এর মধ্যে এ আইন পাস করা কঠিন হবে। সংসদকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এটি বলেছিলাম।
আইনে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, ইসি গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে ২০১২ সালে রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হয়েছিল। তখন থেকেই এই সার্চ কমিটির ধারণা এসেছে। এটি কল্পনা থেকেও আসেনি আকাশ থেকেও পড়েনি। এটা তো নতুন আবিষ্কার নয়। সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুই কমিশন হয়েছে। যার কারণে এটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ফলে জনমত যাচাই তো ১০ বছর ধরে হয়ে গেছে। বিষয়টি হলো তালগাছটি না পেলে অনেক কমপ্লেইন থাকে। তিনি বলেন, দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক কারা হবে সেটি নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা তো আইনে কোথাও বলিনি যে, সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে তাদের নিয়োগ দেয়া যাবে না। বিশিষ্ট নাগরিকের ক্রাইটেরিয়া তো বলে দেয়া হয়নি। কেবল রাষ্ট্রপতিকে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিএনপির এমপিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির জবাবে মন্ত্রী বলেন, ওনারা তো তালগাছ চান। ওনারা কিছুই মানেন না যতক্ষণ তালগাছটা ওনাদের না হয়। এই সংসদই বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে তিন টার্মের জন্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মামলা হলে কোর্ট দু’টি বিধানকেই অবৈধ ঘোষণা করে। তার পরও ওনারা এটার কথা বলবেন। উনারা আদালতের রায়ও মানেন না।
বিএনপির এমপিদের ঐকমত্যের দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঐকমত্য করতে হলে ওনাদের সত্যকে স্বীকার করতে হবে। আর সত্যটি হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সত্য হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ওনারা মানে বিএনপি বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছেন। সত্য হলো ওনারা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে দেননি। খুনিদের পুনর্বাসিত করেছেন। এসব সত্য মেনে জনগণের কাছে মাফ চাইলে আমরা ঐকমত্যে আসব। এ প্রস্তাব মেনে নিলে আমরা ঐকমত্যে আসব।


আরো সংবাদ



premium cement