২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ক্ষমতা খর্বের ভয় ডিএই’র : কার্যকর পদক্ষেপ নেই মন্ত্রণালয়ের

‘কর্তৃপক্ষ’ না থাকায় বাধাগ্রস্ত কৃষিপণ্য আমদানি-রফতানি

-

বিশ্বে কৃষিপণ্যের বাজার ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যের চাহিদাও। বাংলাদেশ হতে কৃষিপণ্য রফতানি ও আমদানিতে কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং। কাগজ কলমে এটি ‘কর্তৃপক্ষ’। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে স্থল, বিমান এবং পোর্টগুলোতে কৃষিজপণ্য আমদানি-রফতানির কর্তৃত্ব করে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা। স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করতে ২০১১ সালে ‘জাতীয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠার আইন পাস হয়েছে। এরপর চলে গেছে ১০ বছর। আমদানি-রফতানির সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন ‘সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ’ না হওয়ায় ক্রমবর্ধমান বড় হওয়া বিশ্ব কৃষিপণ্য বাজারে আমদানি-রফতানি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু, সংশ্লিষ্টরা যেন এতে কানই দিচ্ছেন না। সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা হলে ক্ষমতা খর্ব হবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই)। তাই এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের অনীহা-অনাগ্রহ। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদেরও এ ব্যাপারে তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। যেন তারা চোখ বুঝে বসে আছেন মন্ত্রণালয়ে।
এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব ড. আনোয়ার ফারুক নয়া দিগন্তকে বলেন, কৃষির অনেক কাজ বাকি। এটা (উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ) বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হওয়া এখন জরুরি। না হলে তো ইনকমপ্লিট থেকে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিপণ্য রফতানি বাড়াতে সরকার রাজধানীর শ্যামপুরে সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ করেছে। পূর্বাচলে আধুনিক প্যাক হাউজ স্থাপনের জন্য ২ একর জমি কৃষি মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে সরকার। সেখানে কৃষিপণ্যের রফতানি বৃদ্ধিতে বিশ্বমানের সর্বাধুনিক প্যাক হাউজ এবং অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে। ইউরোপে ফল-সবজি রফতানির বাধা কাটাতে ২০১৭ সালে শ্যামপুরের সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রায় ৬০ কোটি টাকা দিয়ে একটা ল্যাব স্থাপনে মেশিনারিজ আনা হয়েছে ৩ বছর হয়েছে। কিন্তু, দক্ষ জনবল না থাকায় সেই ল্যাবে যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। অথচ এই ল্যাব পরিচালনায় কিছু লোককে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তারা বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ওই ল্যাব আধুনিকায়নে ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। পূর্বাচলে প্যাকিং হাউজ নির্মাণ কার্যক্রমও দ্রুতই শুরু হওয়ার কথা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং-এর পরিচালকের অধীন চলছে এসব কর্মযজ্ঞ। যতই আধুনিক ল্যাব বা প্যাকিং হাউজ নির্মাণ করা হোক না কেন, এসব পরিচালনায় অভিজ্ঞ জনবল কাঠামো সংবলিত স্বতন্ত্র ‘জাতীয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ’ না হলে ফলাফল আগের মতোই হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক ফখরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বতন্ত্র ‘জাতীয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ’ হলে নিজস্ব ও স্থায়ী জনবল কাঠামো হবে। প্রশিক্ষণ দিয়ে অভিজ্ঞ করার পর আর কোনো কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি হতে হবে না। তারা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে ভূমিকা রাখতে পারবেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রচুর কৃষিপণ্য উদ্বৃত্ত থাকে। বিদেশে এসবের অনেক চাহিদা। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল কোয়ারেন্টাইন রুলস মেইনটেইন করতে না পারায় সেসব রফতানি সম্ভব হয় না। আমদানির ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। অনেক সময় কৃষিপণ্য রফতানির পরে সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে রোগ জীবাণু ধরা পড়ায় ফেরত আসে বা ডাম্পিং হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আইন থাকলেও কোয়ারেন্টাইন অথরিটি করার ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) সিনিয়র কর্মকর্তারা বরাবরই অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছেন। তাদের অনেকেই মনে করেন, যেহেতু উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংটি ডিএই’র অধীনে; আলাদা কর্তৃপক্ষ হলে তাদের ক্ষমতা খর্ব হবে। অন্য দিকে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উইং থেকেও অথরিটি করার বিষয়ে তেমন চাপ প্রয়োগ বা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। অথরিটি করার বিষয়ে আইন হওয়ার ১০ বছর কেটে গেলেও কর্মকর্তারা যেন নির্লিপ্তই থেকে গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলমকে বার বার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের (সম্প্রসারণ উইং)অতিরিক্ত সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল নয়া দিগন্তকে বলেন, উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংটা আলাদা হওয়া দরকার। ইতোমধ্যে আমরা (কৃষি মন্ত্রণালয়) কীভাবে এটা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি এটা খুব দ্রতই আলাদা হবে এবং যে উদ্দেশ্যে এই আইনটি (উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন, ২০১১) হয়েছে তার প্রতিফলন ঘটবে। আইন হওয়া দীর্ঘ ১০ বছরেও কর্তৃপক্ষ না হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, না হওয়ার কারণ সুর্দিষ্ট করে বলতে পারবো না। তবে আমি আসার (সম্প্রসারণ উইংয়ের দায়িত্বে) পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে একাধিক চিঠি দিয়েছি। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এবং সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম ফোন ধরেননি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অথরিটি’ হলে তো আরেকটি ডিজির পদ সেখানে ক্রিয়েট হবে। নতুন অফিস হবে। আলাদা জনবল কাঠামো হবে। কৃষি ক্যাডারের লোকজনই তো সেখানে থাকবে। মনে হচ্ছে বিষয়টি ওরা প্রপারলি (ডিএই’র কর্মকর্তারা) বুঝছেন না। এক্সপোর্টার-ইমপোর্টারদেরও এ বিষয়ে চাপ দেয়া উচিত। কারণ এটা হলে কৃষিপণ্যে আমদানি-রফতানিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
এর আগে গত নভেম্বরে ‘জাতীয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএ)। অনুলিপি দেয়া হয়েছে কৃষিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট আরো কয়েক প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাকে। সংগঠনটির সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক এফ আর মালিক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘...উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন,২০১১ মোতাবেক ‘জাতীয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করার বিধান রয়েছে। এই আইন পাস হওয়ার দীর্ঘ ১০ বছর যাবত এই আইনের উপধারা ৩(২) ও ৩(৩) এর মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং-এর খণ্ডকালীন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে জাতীয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষের কার্যাবলি পরিচালিত হয়ে আসছে। ফলে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য অর্জন ও এর কার্যাবলি যথাযথভাবে সম্পাদন সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষত জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র অধীন আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ সংরক্ষণ কনভেনশন ইন্টারন্যাশনাল প্রটেকশন কনভেনশন-আইপিপিসি দ্বারা উদ্ভিদ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে নির্ধারিত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অব ফাইটোস্যানিটারি মেজার্স-৩৮ (আইএসপিএম) সমূহ যথাযথ অনুসরণ ও প্রতিপালন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আমদানি-রফতানিকারকরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। আমাদের কৃষিজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক সুনাম ও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আইএসপিএম’র শর্তাবলি প্রতিপালন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমরা উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য অনেক দেশে রফতানি করতে পারছি না।’
চিঠিতে আরো বলা হয়, সরকার আইপিসি স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে একটি স্বতন্ত্র ‘জাতীয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ’ এনপিপিও প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একইভাবে আইএসপিএম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবেও সরকারের একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার দায়িত্ব অনস্বীকার্য।
এফআর মালিক চিঠিতে আরো লেখেন, অনেক উদ্ভিদ, উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানি ও রফতানিকারকদের আইপিপিসি ও আইএসপিএমের বিধিবিধান এবং এতে উল্লেখিত রোগবালাই প্রকৃত সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে তারা ওই সব বিরোধী ও সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক দেশের কমপ্লায়েন্স মেনে রফতানি করতে পারেন না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট আমদানি ও রফতানিকারকদের পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান প্রদান, প্রশিক্ষণ মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা কেবল ‘জাতীয় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষ’-এর নিজস্ব প্রশিক্ষিত জনবল দ্বারা সম্ভব। বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশিক্ষিত জনবল ও কারিগরি দক্ষতা এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement