২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পর্যটকের নজর কাড়ছে চলনবিলের লাল-বেগুনি-সাদা শাপলা

-

চলনবিল মানেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে হরেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি, শাপলা ফুল আর মাছের সমারোহ। একই সাথে বছরজুড়ে দেশী প্রজাতির পাখির নিত্য আনাগোনা। মাছ-পাখির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী চলন বিল আরো একটি কারণে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। বর্ষা-শরৎ ও হেমন্ত মৌসুমে বিলজুড়ে ফোটে সাদা, লাল, বেগুনি প্রজাতির শাপলা ফুল ও গুল্মলতা। এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল, সাদা ও বেগুনি শাপলা ফুলের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। বর্ষা মৌসুমে বিল-নদীতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় শাপলা। আবহমান কাল থেকেই শাপলা মানুষের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে পাওয়া যেত শাপলা ফুলের মধু (পদ্মমধু) শালুক আর ঢেপের খইয়ের মোয়া। চলনবিল অঞ্চলের স্বল্প আয়ের অভাবী মানুষ বিল থেকে পদ্মমধু, শাপলা-শালুক ও মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন শুকনো মৌসুমে বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির শাপলা, গুল্মলতা, মাছ ও জলজপ্রাণী। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিল ও নদীর জীবনচক্র।
‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ বই থেকে জানা যায়, এক সময় চলনবিল নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। ১৯৬৭ সালে এম এ হামিদ টি কে ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকত। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য সূত্রে জানা যায়, গঠনকালে চলনবিলে মোট প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫ কিলোমিটার থেকে ৩১ কিলোমিটার। এছাড়া বিলের গভীরতা এক দশমিক ৫৩ মিটার থেকে এক দশমিক ৮৩ মিটার; সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ১৩ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ কিলোমিটার।
জানা যায়, কয়েক বছর আগেও চলনবিলের কলমীপাড়া বিল, ছয়আনিবিল, বাঁইড়ারবিল, সাধুগাড়ীবিল, সাঁতৈলবিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাঁকড়ারবিল, কচুগাড়ীবিল, চাতরারবিল, নিহলগাড়ীবিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়িবিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়িবিল, খৈগাড়িবিল, বৃগরিলাবিল, দিগদাড়িয়াবিল, খুলুগাড়িবিল, কচিয়ারবিল, কাশীয়ারবিল, ধলারবিল, ধরইলবিল, আমদাকুরীবিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরীবিল, রঘুকদমা বিল, কুমীরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়িবিল, রহুয়াবিল, সোনাডাঙ্গা বিল, কাতলবিল, বাঘমারা বিল, চিরলবিল, ডিকশীবিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, পাতিয়াবিল, চিনাডাঙ্গী, আইড়মারীবিল, কৈখোলাবিল, কানচগাড়ীবিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গাবিল, মেরীগাছাবিল, খলিশাগাড়ীর বিলে পাওয়া যেত সাদা, লাল ও নীল প্রজাতির প্রচুর শাপলা ফুল।
এ ছাড়া চলনবিলের আত্রাই, গুড়, করতোয়া, ফুলঝোর, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, তেলকুপী (মরা আত্রাই), নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুরা খাল, দোবিলা খাল, বাঁকাই খাড়ি, গোহালা নদী, গাঁড়াবাড়ী-ছারুখালী খাল, বিলসূর্য নদী, কুমারডাঙ্গা নদী, জানিগাছার জোলা, বেহুলার খাড়িতে এখনো নানা রঙের শাপলার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। শুকনো মৌসুমে বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির শাপলা গুল্মলতা ও জলজপ্রাণী।


আরো সংবাদ



premium cement