এবার কাঁচকি মাছের চানাচুর তৈরি বাকৃবি গবেষকদেরা

ইলিশের স্যুপ, নুডুলস, পাঙ্গাশের আচার, মাছের পিৎজার পর এবার দেশী প্রজাতির কাঁচকি মাছের চানাচুর তৈরি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের একদল গবেষক। যেসব শিশু ছোট মাছ খেতে চায় না, তাদের বিকল্প উপায়ে মাছের পুষ্টি গ্রহণের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছে কাঁচকি মাছের প্রক্রিয়া। শুধু কাঁচকি মাছের চানাচুরই নয়, কুড়কুড়ে বাদাম ও তিলের বারও তৈরি করেছেন গবেষকরা। গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গবেষক দলের প্রধান ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ নুরুল হায়দার। সহযোগী গবেষক ছিলেন প্রভাষক মো: মোবারক হোসেন।
ড. মুহম্মদ নুরুল হায়দার বলেন, কাঁচকি দেশী প্রজাতির খুব ছোট এবং প্রায় স্বচ্ছ একটি মাছ। দেশের নদ-নদী, খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। কিন্তু মাছের আকার ছোট এবং কাঁটাযুক্ত হওয়ায় অনেকেই এটি খেতে পছন্দ করেন না। বিশেষ করে ছোট শিশুরা খেতে চায় না। কিন্তু এই ছোট মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান, যা তাদের ঘাটতি থেকে যায়। যারা ছোট মাছ খেতে চায় না বিকল্প উপায়ে তাদের সেই পুষ্টি গ্রহণের উপায় হিসেবে তৈরি করা হয়েছে এ চানাচুর ও বার। দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ থেকে মূল্য সংযোজিত তৈরিকৃত খাদ্য উৎপাদনে গবেষণায় কাঁচকি মাছকে নির্বাচন করি। এতে শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম, প্রোটিন ও ভিটামিন ‘এ’ বিদ্যমান। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কাঁচকি মাছ গুরুত্বপূর্ণ। এ পুষ্টিসমৃদ্ধ মাছ খেতে শিশুসহ অনেকেই অনাগ্রহী। মাছের এ প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল সহজে তারা যেন পেয়ে যায় সে জন্য দু’টি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে ছয়টি পণ্য উৎপাদন করেছি। শিশুসহ সব বয়সের মানুষের চানাচুর ও বার-জাতীয় খাবারটি খুব পছন্দনীয়। তাই ক্যাটাগরি-১ এর পণ্যগুলো মূলত চানাচুর-জাতীয়, অন্য দিকে ক্যাটাগরি-২ এর পণ্যগুলো মূলত কুড়কুড়ে বাদাম ও তিলের বার জাতীয় (যা স্থানীয়ভাবে তিল বাদাম তক্তি হিসেবে পরিচিত) করে তৈরি করা হয়েছে। এতে তারা এসব মুখরোচক খাবারের সাথে মাছের পুষ্টিও গ্রহণ করতে পারবে।
মোবারক হোসেন বলেন, মুখরোচক খাবারে প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান বৃদ্ধির লক্ষ্যেই আমরা মূলত গবেষণা প্রকল্পটি সম্পন্ন করেছি। ছোট মাছের কাঁটা খেতে হবে চিবিয়ে এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম পাওয়া যাবে। অন্য দিকে গর্ভবতী মা ও দুগ্ধদানকারী মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দিয়ে থাকে এ কাঁচকি মাছ। তিনি আরো বলেন, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশ নিউট্রিশন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা যায় চানাচুর-জাতীয় পণ্যগুলোতে গড়ে ৪-৫ শতাংশ ময়েশ্চার, ২৬-৩০ শতাংশ লিপিড, ১৮-২২ শতাংশ প্রোটিন, ৫ শতাংশ মিনারেল, ২ শতাংশ ফাইবার এবং ৩৯-৪২ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। যেখানে সাধারণ চানাচুরে প্রোটিন থাকে ১২-১৩ শতাংশ। বার-জাতীয় পণ্যগুলোতে ২০-২২ শতাংশ ময়েশ্চার, ১৩-১৯ শতাংশ লিপিড, ১৩-১৫ শতাংশ প্রোটিন, ১২-১৫ শতাংশ মিনারেল, ২-৩ শতাংশ ফাইবার এবং ৩২-৩৪ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়।
তিল ও বাদামের পণ্যগুলো তৈরি করা হয় বাদাম, মাছ, তিল ও গুড়ের সমন্বয়ে। প্রথমে উপাদানগুলো স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে শুষ্ক করে নেয়া হয়। যেখানে মাছ, তিল ও বাদাম প্রথমে ভেজে নেয়া হয়। মাছগুলো মিডিয়াম তাপমাত্রায় ভেজে নেয়া হয় এতে মাছগুলো মচমচে হবে। পরে আখের গুড়ের সাথে মিশিয়ে এসব বার তৈরি করা হয়। অন্য দিকে বাজারের তৈরি চানাচুরের সাথে প্রক্রিয়াকৃত মাছ মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে চানাচুর। মাছ দিয়ে তৈরি এসব পণ্যে পরবর্তীতে মাছের কোনো গন্ধ থাকে না। জিপার ব্যাগে পণ্যগুলো দুই মাসের বেশি সময় পর্যন্ত ভালো থাকে বলে জানান গবেষক দলের প্রধান নুরুল হায়দার।
পণ্যগুলোর বাজার মূল্য কেমন হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাণের ২৫ গ্রামের যে পিনাট বার পাওয়া যায় তার দাম ১০ টাকা করে। তাই মাছের তৈরি বারের দাম ১৫-২০ টাকা করে হতে পারে। প্রতি কেজি মাছের তৈরি বার বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা ৬০০ টাকা পর্যন্ত লাভ করতে পারবেন। অন্য দিকে মাছের চানাচুরের দাম নির্ধারণ হবে মাছের পরিমাণের ওপর। চানাচুরে মাছের পরিমাণ যত বেশি হবে তার দামও তত বেশি হবে। এ বিষয়ে ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. ফাতেমা হক শিখা বলেন, এ ধরনের পণ্য বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা গেলে দেশীয় পুষ্টিকর ছোট মাছগুলো সব শ্রেণীর ভোক্তাদের মাঝে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে; যা বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।