১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লামায় বৃষ্টি ও পাহাড় ধসে সাড়ে ৪০০ হেক্টর জমির ফসলহানি

লামায় পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত সবজি ক্ষেত: নয়া দিগন্ত -

টানা বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি, জমিতে পলি জমে ও পাহাড় ধসে এবারে বান্দরবানের লামা উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা, বনপুর ও গয়ালমারা এলাকায়। এখান বেশির ভাগ কৃষক এনজিও, ব্যাংক অথবা চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণের টাকা নিয়েই ফসল আবাদ করেন। এখন
ফসলহানিতে এসব এলাকার সাড়ে ৩০০ কৃষকই দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন। সরকারিভাবে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে, বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকগুণ বেশি বলে দাবি
কৃষকদের। এ ক্ষতিতে নিজেদের খাবার তো জুটবেই না, বরং খাদ্যাভাবে পড়বে পোষা গরু ছাগলও। এ অবস্থায় সরকার সহায়তা না করলে ভিটেবাড়ি বিক্রি ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না
বলে জানান ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
কৃষি অফিস মতে, উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন পাহাড় ও খালের দুই পাড়ের জমিতে রকমারি সবজির আবাদ করেন কৃষকরা। গত মে মাস থেকে তারা জমিতে
আবাদ শুরু করেন ধান, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, তিত করলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙা, শসা, ঢেঁড়স, খিরা, শসা, বরবটিসহ নানান সবজি। ইতোমধ্যে এসব সবজি ক্ষেত থেকে তুলে বাজারে নিয়ে যাওয়ার
উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু আকস্মিক ভারী বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি ও পাহাড় ধসে কৃষকের সবকিছুই ছারখার করে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ফাঁসিয়াখালী
ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইয়াংছা থেকে গয়ালমারা এলাকা পর্যন্ত। এখানে প্রাথমিকভাবে সরকারিভাবে ক্ষতির পরিমাণ মাত্র ১৫ হেক্টর। সব মিলিয়ে উপজেলায় পাঁচ শতাধিক কৃষকের প্রাথমিক
সরকারি ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় ৩০ হেক্টর জমির ফসল। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে কৃষি অফিস। কিন্তু বেসরকারি হিসাব মতে এসব এলাকায় সাড়ে ৩০০ কৃষকের
প্রায় ২০০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া পৌরসভা, লামা সদর, গজালিয়া, ফাইতং, রূপসীপাড়া ও সরই ইউনিয়নে ২৫০ হেক্টর জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁশখাইল্লা ঝিরি মুখের সবজিচাষি নুরুল আবসার জানান, দুই একর জমিতে শসা, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, বেগুনসহ বিভিন্ন রকমারি সবজির আবাদ করেন
তিনি। এতে তার খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু এসব সবজি তুলে বাজারে নিয়ে যাওয়ার আগেই বৃষ্টি ও ঢলের পানি সবকিছু ছারখার করে দিয়েছে। তিনি আরো জানান,
ঋণ, স্বর্ণ বন্ধক ও হাওলাতি টাকা নিয়ে সবজি চাষ করেন তিনি। আরেক চাষি নুরুল কবির প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ করে চার একর জমিতে বর্ষাকালীন সবজি চাষ করেছেন। ইতোমধ্যে ফসল
বাজারে নেয়ার সময়ও হয়েছিল। কিন্তু বৃৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এক টাকারও সবজি বিক্রি করতে পারেননি। জমিতে পলি জমে মরে যাচ্ছে গাছ আর ক্ষেতেই সব নষ্ট হয়ে গেছে সবজি।
এখন দেনার দায়ে ভিটেবাড়ি ছাড়ার উপক্রম হয়েছে। একই এলাকার কৃষক ছাদু মার্মা, মো: মুছা, হাবিবুর রহমান, বড়পাড়ার চচা মার্মা, নুরুল আবসার, নাছির উদ্দিন, মো: আলমগীর, আচিং
মার্মা, প্রুথোয়াই, আনোয়ার, মো: ছোটন, নুরুল আলমসহ আরো অনেকে জানালেন একই তথ্য। তারা জানান, ফাঁসিয়াখালীর ৯নং ওয়ার্ডে প্রায় সাড়ে ৩০০ কৃষক সবজি চাষ করেন। এসব কৃষক
এবার প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিনে চাষ করেছেন কাঁকরোল, তিত করলা, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, বরবটি, শসাসহ বিভিন্ন রকমারি সবজি। ইতোমধ্যে ফলনও এসেছিল। কিন্তু ফসলহানিতে তাদের কম করে
হলেও কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে ইয়াংছা খালের তীরবর্তী সবজিক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক।
এ দিকে বড়বিল এলাকার কৃষক ছানু মং, ওসমান, সিরাজ, জব্বার ও কাদের হোসেন বলেন, আমাদের ফসল বৃষ্টি ও পানিতে ডুবে গেছে। পানি কমে যাওয়ার পরপর ফলনসহ গাছ মরা শুরু
করে। আমরা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সবজি লাগিয়েছি। আমাদের মতো আরো অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে ধান ও অন্য চাষাবাদ করেছে। এখন ঋণের টাকা শোধ করব কেমন
করে? খাবো কেমন করে, চিন্তায় আছি।
ইয়াংছা এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অমর জিৎ দে জানিয়েছেন, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা ব্লকের পাহাড় ও খালের দুুইপাড়ে ব্যাপক হারে সবজি চাষ হয়ে থাকে। তবে
সাম্প্রতিক টানা বৃষ্টিতে কৃষকের সবজি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি গাছও মরে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমার ব্লকে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৫ হেক্টর ধরা হয়েছে। ঘরে ঘরে গিয়ে তালিকা করা হলে
ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলেও জানান তিনি।
টানা বর্ষণে ইয়াংছা এলাকায় সবজি চাষের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আপ্রুচিং মার্মা জানায়, ‘আমার ওয়ার্ডের বেশির ভাগ মানুষ ইয়াংছা খালের
দুইপাড় ও পাহাড়ে সবজি ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এসব কৃষক বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ধান ও অন্য চাষাবাদ করে আসছেন। প্রথমবারের ফসল হানিতে কম করে হলেও সাড়ে ৩০০
চাষির প্রায় ২০০ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন দেনার দায়ে কৃষকদের ভিটেবাড়ি ছাড়তে হবে মনে হচ্ছে।
কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনাসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়ে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো: জাকের হোসেন মজুমদার বলেন, ‘ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন
ইয়াংছা ও বগাইছড়ি খাল বেষ্টিত। ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। তাই বর্ষা মৌসুমে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সবজিচাষ হয় এখানে। পাহাড়ি ঢলের তাণ্ডবে সবজি
চাষিদের এখন মাথায় হাত উঠেছে। সরকারিভাবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনাসহ নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হলেও কৃষকরা কিছুটা হলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।
এ ব্যাপারে লামা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা সানজিদা বিনতে সালাম জানান, টানা বৃষ্টি ও পাহাড় ধসে উপজেলায় কৃষকের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির
পরিমাণ নির্ধারণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement