২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সমীক্ষাহীন প্রকল্প সংস্কৃতি অনুমানেই খরচ প্রাক্কলন

তৃতীয় পক্ষ নয়, সম্ভাব্যতা যাচাই করছে নিজেরাই; খাতভিত্তিক ব্যয় নিয়ে আপত্তি পরিকল্পনা কমিশনের;বছর না পেরোতেই লাফিয়ে বাড়ছে প্রকল্পের খরচ
-

কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ ২৫ কোটি টাকার বেশি হলে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত পরিপত্রে। কিন্তু এই বিধিবিধান বা নির্দেশনা মানছে না প্রকল্প প্রণয়নকারী বেশির ভাগ মন্ত্রণালয় বা বিভাগ। চলছে দায়সারাগোছের সম্ভাব্যতা যাচাই, সমীক্ষাহীন প্রকল্প তৈরির সংস্কৃতি। তৃতীয় পক্ষ দ্বারা কোনো সমীক্ষা করা হচ্ছে না। আর অনুমানের ওপর ভর করে প্রকল্পের খরচ প্রাক্কলন করে প্রস্তাবনা দাখিল করা হচ্ছে। ফলে প্রকল্পে খাতভিত্তিক ব্যয় নিয়ে ঘোর আপত্তি জানাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। অনুমোদন পাওয়ার পর বছর না যেতেই লাফিয়ে বাড়ছে বাস্তবায়ন খরচ।
সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কিত পরিপত্র ৪.১ ধারা অনুযায়ী, ২৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় হলে প্রকল্প গ্রহণের আগে আবশ্যিকভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে হবে। তবে এ নিয়ম মানছে না বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নেয়ায় সেগুলো বাতিল করা ছাড়াও বারবার প্রকল্প সংশোধন করতে হয়। সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প না নেয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনাও রয়েছে। তারপরও সমীক্ষা ছাড়াই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের অনুমোদনের ভিত্তিতেই প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হচ্ছে। আবার প্রভাবশালী মহলের চাপের মুখে পরিকল্পনা কমিশন এ ধরনের প্রকল্প অনুমোদন দিতে বাধ্যও হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দু’টি প্রকল্প পর্যালোচনা থেকে জানা গেছে, তৃতীয় পক্ষ দিয়ে এসবের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। অথচ একটি প্রকল্পের খরচ ৮২৮ কোটি টাকা এবং অন্যটি ৬৬৩ কোটি টাকার। দু’টি প্রকল্পই নদীর তীর সংরক্ষণ। বরগুনায় বিষখালী ও পায়রা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের খরচে আপত্তি জানিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সেচ উইং বলছে, ১৭টি রেগুলেটর নির্মাণের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪১ কোটি দুই লাখ টাকা। এখানে প্রতিটি রেগুলেটরে খরচ পড়বে দুই কোটি ৪১ লাখ টাকা, যা সমজাতীয় প্রকল্পের চেয়ে বেশি। তিনটি রেগুলেটর মেরামতে ধরা হয়েছে তিন কোটি ৪৫ লাখ টাকা। প্রতিটিতে ব্যয় হবে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা। একটি সাইট অফিস নির্মাণে খরচ এই প্রকল্পে ধরা হয়েছে এক কোটি টাকা। এটি বাদ দেয়া প্রয়োজন বলে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মনে করছে। এ ছাড়া সাড়ে ২২ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছে পাঁচ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। প্রতি কিলোমিটার খাল পুনঃখননে ব্যয় হবে ২৪ লাখ ৭১ হাজার টাকার বেশি। এই খাল পুনঃখননের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন পরিকল্পনা কমিশনের।
একইভাবে পানগুছি নদীর ভাঙন থেকে মোরেলগঞ্জ উপজেলাকে রক্ষা ও বিষখালী নদী পুনঃখনন খরচ হবে ৬৬৩ কোটি টাকা। এই প্রকল্প প্রস্তাবনায়ও প্রকাশ পেয়েছে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করা হয়নি। তৃতীয় পক্ষ দ্বারা এই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার জন্য বলেছে কৃষি পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সেচ উইং। এখানে সমীক্ষায় বন্যা ফিরে আসার সময়সহ কমপক্ষে বিগত ১০ বছরের পানির স্তরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উচ্চতা, স্রোতের গতিবেগ, নদীর তীর ভাঙনের চিত্র, মৃত্তিকা পরিস্থিতি ও পলি বা বালি জমা হওয়ার তথ্যসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সংযোজন করতে বলা হয়েছে।
প্রকল্প দুটোর ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলছে, প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদন করা হয়নি। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অভ্যন্তরীণ কমিটির সাথে পানিসম্পদ সেক্টরের অন্যান্য সংস্থায় কর্মরত যেমন, বুয়েটের আইডব্লিউএফএম অথবা সিইজিআইএস, আইডব্লিউএম ওয়ারপো একাধিক বহিঃস্থ সদস্যের সমন্বয়ে হালনাগাদ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে ব্যয় যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা তৃতীয় পক্ষ দ্বারা সম্পন্ন করতে হবে। সমীক্ষায় নদীর ক্ষেত্রে বন্যা ফিরে আসার সময়সহ কমপক্ষে বিগত ১০ বছরের পানির স্তরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উচ্চতা, স্রোতের গতিবেগ, নদীর তীর ভাঙনের চিত্র, মৃত্তিকা পরিস্থিতি ও পলি বা বালি জমা হওয়ার তথ্যসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সংযোজন করতে হবে।
এর আগে ২০২০ সালে পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে কুমিল্লার জেলা মহাসড়কে যথাযথ প্রশস্তকরণ ও উন্নয়নের জন্য ৯৮২ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প। ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কে তিনটি আন্ডারপাস ও পদুয়া বাজার ইন্টারসেকশনে দু’টি ইউলুপ নির্মাণ হবে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১২ কোটি তিন লাখ টাকা। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের নিমিত্তে মাদরাসা শিক্ষকদের শিক্ষণ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণসংক্রান্ত প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে, যার খরচ ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৭৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এসব প্রকল্প আবার পাসও হয়ে যায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভা (একনেক) থেকে।
এডিপি নিয়ে সচিবদের সাথে পর্যালোচনা সভায় সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের কয়েকজন সদস্য (সচিব) জানান, ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে বা সঠিকভাবে স্টাডি না করে প্রকল্প প্রণয়ন করার কারণে প্রকল্পের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যায় না। আর এই স্টাডি না করার কারণে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যা চিহ্নিহ্নতকরণ, প্রয়োজনীয়তা যাচাই, আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ না করা বা কারিগরি দিক যথাযথভাবে বিবেচনায় আসে না। ফলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে ওভার এস্টিমেট বা অবাস্তব ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়।
এ ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান স্বীকার করেন, প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে। তবে এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।


আরো সংবাদ



premium cement