গ্রামেগঞ্জে করোনার পরীক্ষা হচ্ছে না
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ০২ আগস্ট ২০২১, ০০:০৬
করোনা মোকাবেলায় জনসম্পৃক্ত ও সরকারি উদ্যোগের সমন্বয় প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেছেন দেশের বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলেছেন, করোনা মোকাবেলায় জনসম্পৃক্ততার অভাব দেখা দিচ্ছে। গ্রামগঞ্জে করোনার কোনো পরীক্ষা হচ্ছে না। ফলে সেখানে ভয়াবহ আকারে মানুষজন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। এই মুহূর্তে গার্মেন্ট কারখানা খুলে দেয়া কোনোভাবে উচিত হয়নি।
‘করোনা মোকাবেলায় স্থানীয় জনসম্পৃক্ত উদ্যোগ’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে এ কথাগুলো বলা হয়। গতকাল এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং দি হাঙ্গার প্রজেক্ট এই সংলাপের আয়োজন করে।
আলোচনায় উল্লেখ করা হয়, দেশে গত মার্চ মাস থেকে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কোভিডের ডেল্টা (ভারতীয়) রূপটি মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য চলমান সংক্রমণের শৃঙ্খলকে ভেঙে ফেলা। এই শৃঙ্খলকে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যকারভাবে ভেঙে ফেলা সম্ভব, যেমন মানুষের আচরণের পরিবর্তনসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা; সংক্রমিত রোগীদের বিচ্ছিন্ন করা; সংক্রমিত হওয়ার সন্দেহ রয়েছে এমন ব্যক্তিদেরকে পৃথকীকরণের ব্যবস্থা করা; এবং টিকার আওতা বৃদ্ধি। প্রকৃতপক্ষে, কোভিড মোকাবেলায় এগুলোই বর্তমানে প্রকৃত উপায়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, এই করোনাভাইরাস সম্পর্কে এখনো মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে অনীহা এই সংক্রমণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ডেল্টা (ভারতীয়) রূপটি অতিমাত্রায় সংক্রামক একইসাথে উপসর্গহীন রোগীর আধিক্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। এ অবস্থায় আচরণগত পরিবর্তন প্রয়োজন। সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কার্যক্রমের সাথে স্থানীয় পর্যায়ের জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্তকরণের উদ্যোগের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশমালা মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় পর্যায়ে বহুপক্ষীয় প্রয়াস থাকলেও এগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রবল।
মোস্তাক রাজা চৌধুরী বলেন, করোনা মোকাবেলায় জনসম্পৃক্ততার অভাব দেখতে পাচ্ছি। এভাবে চললে এই ধরনের মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।
মূল প্রবন্ধে হাঙ্গার প্রজেক্টের ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই করোনাভাইরাস সহজে যাবে বলে মনে হয় না। তাই এটিকে মোকাবেলা করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমরা ‘করোনা সহনশীল গ্রাম’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি। এই গ্রামের বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকবে। করোনা মোকাবেলায় এই গ্রামে জনসম্পৃক্ততা থাকবে। থাকবে সচেতনতা। এই সচেতনতার মধ্যে থাকবে মাস্ক পরিধান করা, সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া এবং দূরত্ব বজায় রেখে চলা। এখানে রোগী ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাও থাকবে।
তিনি বলেন, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে প্রায় ১,২০০ গ্রামে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সক্ষম গ্রাম (সিআরভি) উদ্যোগ গ্রহণ করে। ভাইরাসের বিস্তার রোধে প্রযুক্তিগত নির্দেশিকা অনুসরণ করে এই মডেল গ্রামগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা পরিচালিত এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে আশাব্যঞ্জক উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল আরো বেশি করে করোনা পরীক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, গ্রামে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে না। গ্রামের লোকজন এখনো মনে করছে, যেহেতু বর্ষাকাল চলছে, তাই এসময় একটু সর্দি-কাশি-জ্বর হতেই পারে। তাই তারা এ নিয়ে ঘরে থাকছে, বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে এবং এতে করে আরো ১০-১২ জনকে করোনায় আক্রান্ত করছে। এখন সময় এসেছে গ্রামে লোকজনকে মাস্ক পরাসহ সম্পৃক্ত করে করোনার টিকা নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
রাজশাহী অঞ্চলের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পাশাপাশি করোনা মোকাবেলায় জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে তা না হলে করোনার সংক্রমণ কমানো যাবে না।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা: লেলিন চৌধুরী গার্মেন্ট কারখানা খুলে দেয়ার চরম সমালোচনা করে বলেন, এই কারখানাগুলো খুলে দেয়ার কারণে কত লোক অসুস্থ হবে, কত লোক হাসপাতালে যাবে বা মারা যাবে তার কি কোনো পরিসংখ্যান আমরা করেছি। যদি আমরা এই হিসাব করতে পারি তবে কলকারখানা খুলে দেয়ার যে দাবি করা হয় তা ধোপে টিকবে না।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রেখে বলেন, করোনা মোকাবেলায় জনসম্পৃক্ত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। তিনি আরো বলেন, জনসম্পৃক্ত ও সরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনার অভাব রয়েছে।
মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান এমপি মন্তব্য করেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনা সম্পর্কে এখনো অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি অনেক উদ্যোগ রয়েছে কিন্তু এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর আরো জোর দিতে হবে।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি); অধ্যাপক রওনক জাহান, সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং আনির চৌধুরী, পলিসি অ্যাডভাইজার, এক্সেস টু ইনফরমেশন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংলাপে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক রওনক জাহান করোনা সচেতনতা বৃদ্ধিতে সমন্বয়ের অভাবের কথা বিশেষভাবে তুলে ধরে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপরে গুরুত্ব দেন। আনির চৌধুরী বলেন, করোনা মোকাবেলায় শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়। তিনি পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের উপর জোর দেন। তিনি বলেন, স্বেচ্ছাসেবামূলক উদ্যোগ যারা নিচ্ছেন তাদের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে হবে। তাহলেই সমন্বিতভাবে কাজ করা সম্ভব হবে। করোনা মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার জন্য অধ্যাপক রেহমান সোবহান নাগরিক সমাজের সাথে উপজেলা পর্যায়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের একটি উদাহরণ সৃষ্টি করার কথা বলেন। এরকম উদাহরণ তৈরি করতে পারলে অন্যান্য সব স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে বলে তিনি মনে করেন।
সংলাপে বিশেষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বপন কুমার দাস, উপজেলা চেয়ারম্যান, বেতাগা, ফকিরহাট, বাগেরহাট এবং সাঈদ মেহেদী, চেয়ারম্যান, কালিগঞ্জ উপজেলা, সাতক্ষীরা। তারা মন্তব্য করেন, গ্রাম পর্যায়ে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং এখনো সচেতনতা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা যায়নি।
সংলাপে সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের (সিলেট বিভাগ) সদস্য, অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্স; ডা: লেলিন চৌধুরী, পরিচালক, হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; সেলিমা সারওয়ার, নির্বাহী পরিচালক, অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (এসিডি); স্বপন কুমার গুহ, নির্বাহী পরিচালক, রূপান্তর এবং বজলে মোস্তফা রাজী, নির্বাহী পরিচালক, ফ্রেন্ডস ইন ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ (এফআইভিডিবি)। তারা সবাই জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন এবং করোনা সম্পর্কিত অসচেতনতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।
সংলাপে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ হেলথ্থ ওয়াচের সমন্বয়ক ও ব্র্যাকের সাবেক ভাইস চেয়ারপারসন ড. মোস্তাক রাজা চৌধুরী।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা