২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এনজিওর গ্যাঁড়াকলে খেটে খাওয়া মানুষরা

কিস্তির চাপে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন; অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন
-

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা যখন জীবন চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, আর্থিক সঙ্কটে পরিবার-পরিজন নিয়ে দিশেহারা, দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে না খেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে জীবনযাপন করছেন ঠিক তখনই দেশের বেশ কিছু এনজিও ঋণের কিস্তি আদায় নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করেছে। কিছু এনজিওকর্মী টাকা আদায়ের জন্য বাড়িতে গিয়ে বসে থাকেন, আবার কেউ সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারলে কখনো কখনো মোবাইলে কল দিয়ে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছেন। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন কর্মহীন ওই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষেরা। তাদের কেউ কেউ কিস্তির টাকা পরিশোধের বাড়তি চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আবার উপায়ন্তর না পেয়ে শেষমেশ লোক লজ্জার ভয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, করোনার কারণে ব্যবসা মন্দ দেখা দেয়ায় কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারছিলেন না বগুড়ার আদমদীঘির ধান-চাল ব্যবসায়ী এনামুল হক প্রামাণিক। তার বাড়িতে এসে এনজিওকর্মী ও পাওনাদাররা চাপ সৃষ্টি করেন এবং তাকে অসম্মানজনক কথা বলতে থাকেন। এসব চাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং একপর্যায়ে এ মাসের প্রথম দিনেই বিষাক্ত ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেন ওই ব্যবসায়ী। এ রকমই একজন গাজীপুরের শ্রীপুরের রুবেল মিয়া। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও করোনার মধ্যে তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন চালানোর জন্য অদম্য সংগ্রাম করছিলেন। তারই অংশ হিসেবে একটি এনজিওর কাছ থেকে কৃষিকাজের উন্নতির জন্য মাত্র ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন রুবেল। এনজিওর মাঠকর্মী বাড়িতে গিয়ে ঋণের টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন তিনি। টাকা পরিশোধের উপায়ন্তর না পেয়ে শেষমেশ গত ২ এপ্রিল বিষপানে আত্মহত্যা করেন ওই প্রতিবন্ধী কৃষক।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার মনিরামপুরে এনজিওর ঋণের কিস্তির টাকা আদায়ের চাপ সইতে না পেরে গৃহবধূ লিপিকা মণ্ডল গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। গত বছরের ৯ জুন নওগাঁর রানীনগরের বড়িয়া গ্রামের দিনমজুর ছাইদুল ইসলাম ব্র্যাকের ঋণের কিস্তির চাপ সইতে না পেরে অতিরিক্ত পরিমাণে গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেন। এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর কিস্তি আদায়ের জন্য চাপ দেয়ায় পাবনার ফরিদপুরের হাঙ্গড়াগাড়ি গ্রামের গৃহবধূ সাবিনা খাতুন গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এ দিকে করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়ায় সংসার চালাতে স্ত্রীর নামে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মুদি দোকান দেন বগুড়া শহরতলীর নওদাপাড়া গ্রামের মহিদুল ইসলাম। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ঋণের কিস্তির চাপ সহ্য করতে না পেরে গত বছরের ১০ নভেম্বর ওই মুদি দোকানির গর্ভবতী স্ত্রী বুলবুলি বেগম পোকা নিধন বিষাক্ত ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। দায় দেনা মেটাতে আগেই বসত ভিটা বিক্রি করে দেন কুমিল্লার দাউদকান্দির সিংগুলা গ্রামের চা বিক্রেতা কামাল হোসেন। করোনার মধ্যে অসহায় হয়ে পড়ায় সংসার জীবন চালাতে গিয়ে কয়েকটি এনজিওর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন তিনি। কিন্তু ওই ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় লোকলজ্জার ভয়ে গত ১৫ ডিসেম্বর দোকানেই আত্মহত্যা করেন ওই চা বিক্রেতা।
এনজিওর কিস্তির চাপেও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ। তেমনি একজন মেহেরপুরের কলাইডাঙ্গার কেসমত আলী। কিস্তির টাকা দিতে না পারায় এনজিওকর্মীদের চাপে পরিবার নিয়ে গত ১৬ মে ঢাকায় পালিয়ে যান তিনি। সাভারের ভাদাইল এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন এবং একটি হোটেলে দিনমজুরের কাজ নেন কিসমত। দু’দিন কাজ করতে না করতেই আবার বেকার হয়ে পড়েন তিনি। এ সময় পরিবার পরিজন নিয়ে ভাড়া বাসায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন কিসমত। একপর্যায়ে গত ২২ মে সকালে তিনি চা খাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। এ ব্যাপারে আশুলিয়া থানায় তার পরিবার একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকÑ সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, এখন যে সঙ্কট চলছে সেটা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য নয়, এটা করোনার কারণে হয়েছে। দেশের একটি বড় অংশ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। ঋণভিত্তিক যেসব এনজিও আছে তারা গরিব মানুষকে ঋণ দিয়ে সহায়তা করে। করোনার মধ্যে ঋণগ্রহীতারা কর্মহীন হয়ে বিপদে পড়েছে, আবার ঋণদান সংস্থাগুলোও সমস্যার মধ্যে রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ঋণ আদায়ের জন্য ঋণগ্রহীতা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কাজ করা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে যারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না অন্তত তাদের জন্য সরকার এগিয়ে আসতে পারে। এটাও দেখতে হবে, ঋণদান সংস্থাগুলো যাতে অস্তিত্বহীন হয়ে না পড়ে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো: নুরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে যে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা বা এনজিওগুলো আছে এগুলো সরকারের নির্দেশনার কোনো তোয়াক্কা করে না। যদিও তারা দারিদ্র্য বিমোচন, মানব উন্নয়ন, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানবিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার চর্চাসহ জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রম পুরো উল্টো। জনগণের কল্যাণ তো হয়-ই না, বরং কল্যাণ হয় শুধু ওই সংস্থাগুলোর সাথে যারা জড়িত কেবল তাদের। তিনি আরো বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গরিব খেটে খাওয়া মানুষেরা বিপদে পড়ে, মারাত্মক জুলুমের শিকারও হয়। এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ গরিব মানুষের জন্য এক সময় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয়। আমি মনে করি, কেউ বিপদে পড়লে কিস্তি আদায়ের জন্য কোনোভাবেই চাপ দেয়া ঠিক নয়। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলো যে লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই লক্ষ্যের পরিপন্থী কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

 


আরো সংবাদ



premium cement