১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাকা জামের মধুর রসে রঙিন হয় না মুখ

-

‘পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ’Ñপল্লী কবি জসীমউদ্দীনের ‘মামার বাড়ি’ কবিতার এই পঙক্তির সাথে পরিচিত নয় এমন লোক এদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এক সময় মানুষ জামগাছ তলায় যেত না কালো রসের ভয়ে। আর এখন কালো জামের দেখা মেলা ভার। খোকা-খুকিদের মুখে এখন রঙিন রসের চিহ্ন দেখা যায় না। এই সময় সাধারণত গ্রামেগঞ্জে আম-জাম-কাঁঠালের মিষ্টি রসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পরম উপকারী কালো জাম ফলটি সব মানুষের কাছে সমাদৃত। কিন্তু মানিকগঞ্জে সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে জামগাছ।
রসে ভরা এই কালো জাম এক সময় বিখ্যাত ছিল মানিকগঞ্জে। গ্রাম-গঞ্জের বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে জেলার প্রায় সর্বত্রই এক সময় প্রচুর জামগাছ চোখে পড়ত। নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জের পথেঘাটে, হাটবাজারে ও সড়কের পাশে জামগাছ এখন তেমন দেখা যায় না। জাম ফল এখন চলে গেছে দামি ফলের তালিকায়। তাই মানবদেহের জন্য অত্যন্ত গুণসম্পন্ন পাকা জামের মধুর রসে এখন আর শিশু-কিশোরদের মুখ রঙিন হয় না।
স্কুলশিক্ষিকা ও কবি তানিয়া আফরোজ স্মৃতিচারণ করে বলেন, প্রত্যেকের জীবনের মধুর একটি সময় শৈশব। দিনগুলো ছিল দুরন্তপনা, দুষ্টুমি আর সারা দিন ছোটাছুটি করে দৌড়ে বেড়ানোর এক মুহূর্ত। আমার শৈশব যেন আজো আমাকে ডাকে বলে আয়-ফিরে আয়। একটি কথা না বললেই নয়। বন্ধুরা মিলে খুব ভোরে আমাদের বড় জাম গাছটার তলায় উপস্থিত হতাম। কার আগে কে আসে এই প্রতিযোগিতা চলত। এরপর জাম খাওয়ার কথা আজো ভীষণ মনে পড়ে। খুব মিষ্টি, তবে মুখ মেখে যেত রঙে। কে কত বেশি মুখ রাঙাতে পারে। জাম খাওয়া নিয়ে বাবা-মায়ের বকুনি যেন কানে বাজে। আজো মনে পড়ে সেই দিনের স্মৃতিগুলো।
মানিকগঞ্জের প্রায় সব এলাকায় বাড়ির আঙিনায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে কিংবা রাস্তার দু’ধারে জামগাছ ছিল চোখে পড়ার মতো। উপজেলার কেল্লাই বাজারের পাশে, রাথুরা অটল সাহার বাড়ি, বরটিয়া ক্লাব ঘরের পাশে, রাধাকান্তপুর মাঠের কোনায়, ঘিওর ডিএন পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের পিছনে, থানার মোড়, উপজেলা পরিষদ চত্বর, বানিয়াজুরী, রাথুরা-তরা রাস্তা, জাবরা, বালিয়াখোড়া, সিংজুরী, তেরশ্রী রাস্তা, সরকারি ডিগ্রি কলেজের পেছনের রাস্তা, পঞ্চরাস্তা মোড়, বরটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সড়ক, নালী-কেল্লাই সড়কের দু’পাশে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকা-পুখুরিয়া রাস্তা, বাষ্টিয়া খেলার মাঠ, পয়লা গ্রামীণ রাস্তা, ভোর বাজার, আশাপুর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় একা কিংবা সারিবদ্ধভাবে জামগাছ চোখে পড়ে।
বাংলাদেশ প্ল্যান্ট ট্যাক্সোনোমিস্ট সমিতির সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, শুধু ফল নয় জামগাছ তীব্র রোদে পশুপাখি ও মানুষের স্নিগ্ধছায়া দান করে। জামগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি হতো বাহারি সব আসবাবপত্র। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখন জামগাছ রোপণ না করায় গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে জাম বিক্রি হচ্ছে চড়াদামে। বাজারে এক কেজি কালো জাম ১ শ’ থেকে দেড় শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন হাট-বাজার, বাসস্ট্যান্ড খুচরা ও পাইকারি বিক্রি হয় জাম। আবার অনেক ব্যবসায়ী গাছ থেকেই জাম কিনে থাকেন। পরে পাইকাররা এসব জাম বিক্রি করে আশুলিয়ার বাইপাইল ও রাজধানীর কাওরানবাজার আড়তে। এছাড়াও ফেরিওয়ালারা বিভিন্ন জনবহুল স্থানে ফেরি করে বিক্রি করে কালো জাম। বড় বড় গাছ ও বাগান কেটে সাফ করে ফেলায় এখন এই কালো জামের উৎপাদন কিংবা ফলন কমে গেলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি।
ঘিওরের শ্রীবাড়ি এলাকার পাইকারি জাম ব্যবসায়ী মো: আরিফ হোসেন জানান, জেলার বিভিন্ন হাটবাজার কিংবা বসতবাড়ি থেকে জাম কিনে তিনি আশুলিয়ার বাইপাইল আড়তে বিক্রি করেন। খরচ বাদে কেজি প্রতি ১০-১২ টাকা লাভ হয়। মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা: আব্দুল করিম বলেন, জাম মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী ফল। মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকরী। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ রোগীদের জন্য জাম অনেক উপকারী। কারণ জাম ফল রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ও রক্তে চিনির মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও গর্ভবতী মা, শিশুদের জন্যও এই ফল ভীষণ উপাদেয়। জামের ভিটামিন ‘এ’ দৃষ্টিশক্তিকে করে শক্তিশালী।
আজকাল শখের বশে অনেকেই বসতবাড়ি কিংবা বাগানে জামগাছ রোপণ করছেন। এ বিষয়ে বানিয়াজুরীর রিফাত নার্সারির মালিক আব্দুর রশিদ বলেন, আমাদের দেশে প্রধানত দুই জাতের জাম পাওয়া যায়। ক্ষুদি জাত- খুব ছোট এবং কালো জাম বা মহিষে জাত- বেশ বড় ও মিষ্টি। বছর দুই তিন ধরে মানুষজনের জামগাছের চারা কেনার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাইব্রিড জাতের জাম বেশ বড় এবং দেখতেও নজরকাড়া। একেকটি জামচারা তিনি আকারভেদে ৫০ থেকে ২ শত টাকা বিক্রি করেন। ঘিওর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ বিপুল হোসেন বলেন, জাম একটি পরিচিত ফলদ বৃক্ষ। জামের রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক হারে জামগাছের চারা রোপণ করা হচ্ছে। স্থানীয় ভালো জাতের বীজ নির্দিষ্ট স্থানে রোপণ করে বা এক বছর বয়সের চারা রোপণ করে জামের আবাদ করা যায়।


আরো সংবাদ



premium cement