২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রকৃতি থেকে কমে যাচ্ছে বর্ষার স্মারক কদম ফুল

-

আষাঢ়-শ্রাবণ মাসজুড়ে কদম ফুলে ভরা থাকে গাছ। রিমঝিম বৃষ্টিতে মনে থাকে স্বস্তির ছোঁয়া। দেখে তৃপ্ত হয় সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ। প্রিয়জনকে কদম ফুল উপহার দেয়ার রীতিও বেশ পুরনো। গ্রামের শিশু কিশোররা কদমতলায় ফুল নিয়ে খেলা করত। কিন্তু আজ ধীরে ধীরে তা হারিয়ে যেতে চলেছে। যেন আকাল পড়েছে কদম ফুলের সৌন্দর্যে। যান্ত্রিক যুগে মানুষ অতীত ঐতিহ্য ভুলতে বসেছে। বাড়ির আশপাশে ফলমূল ও ফুলের গাছ না লাগিয়ে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফার আশায় পাহাড়ি গাছ লাগাচ্ছে।
দিন দিন মানিকগঞ্জের প্রকৃতি থেকে কমে যাচ্ছে চিরচেনা বর্ষার স্মারক কদম ফুল। ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জের গ্রাম কিংবা শহরের সর্বত্রই বর্ষার আগমনীতে নিজেদের মেলে ধরত আপন মহিমায় কদম ফুল। বাড়ির আঙ্গিনায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে কিংবা রাস্তায় দুই ধারে কদমগাছ ছিল চোখে পড়ার মতো। উপজেলার ঘিওর ডিএন পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে, থানার মোড়, উপজেলা পরিষদ চত্বর, বানিয়াজুরী, রাথুরা-তরা রাস্তা, জাবরা, বালিয়াখোড়া, সিংজুরী, তেরশ্রী রাস্তা, সরকারি ডিগ্রি কলেজের পেছনের রাস্তা, পঞ্চরাস্তা মোড়, বরটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সড়ক, নালী-কেল্লাই সড়কের দু’পাশে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকা-পুখুরিয়া রাস্তা, বাষ্টিয়া খেলার মাঠ, পয়লা গ্রামীণ রাস্তা, ভোর বাজার, আশাপুর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় একা কিংবা সারিবদ্ধভাবে কদম গাছ চোখে পড়ে। কদম ফুল না ফুটলে যেন বৃষ্টি ঝরে না, কদমকে নিয়ে এত কবিতা-গল্প আর ভালোবাসার পঙক্তিমালা; সেই কদম গাছ এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বানিয়াজুরী-ঘিওর সড়কের বানিয়াজুরী এলাকায় দু’টি ব্যক্তিগত গাড়ি থামিয়ে পরিবারের সবাই কদম ফুলের ছবি তুলছে। সাথে কদম গাছ ও ফুলের সাথে সেলফি। আলাপচারিতায় জানা গেল, আব্দুর রশিদ ও মাহবুব উল আকন্দ দু’জনে ভায়রা ভাই। ঘিওর উপজেলা সদরে তাদের শ্বশুরবাড়ি। দু’জনেই ব্যবসায়িক কাজে সপরিবারে দেশের বাইরে থাকেন। করোনাকালীন সমস্যাজনিত কারণে বছর দেড়েক ধরে ঢাকার বাসায় আছেন। গত ছয় মাসে এবারই ঢাকার বাইরে বেরিয়েছেন। অজস্র ফুটন্ত কদম ফুল দেখে আর লোভ সংবরণ করতে পারেননি। গাড়ি থামিয়ে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে কদম ফুলের সাথে ছবি তুলে স্মৃতি রোমন্থন করে যাচ্ছেন। ছোট শিশুরা আনন্দে উদ্বেলিত।
বাংলাদেশ প্লান্ট ট্যাক্সোনোমিস্ট সমিতির সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, কদম নামটি এসেছে সংস্কৃত নাম কদম্ব থেকে। কদমের বৈজ্ঞানিক নাম অহঃযড়পবঢ়যধষঁং রহফরপঁং। এটি নীপ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশ, ভারতের উষ্ণ অঞ্চল, চীন, মালয় কদমের আদি নিবাস। বৃত্তপুষ্প, সর্ষপ, ললনাপ্রিয়, সুরভী, মেঘাগমপ্রিয়, মঞ্জুকেশিনী, পুলকি, কর্ণপূরক এসবও কদম ফুলের নাম।
সাধনা ঔষধালয়ের মানিকগঞ্জ শাখার হেকিম উত্তম পালিত বলেন, শুধু বর্ষায় প্রকৃতির হাসি নয়, এর রয়েছে নানা উপকারিতাও। কদম গাছের ছাল জ্বরের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কদম গাছের কাঠ দিয়ে দিয়াশলাই তৈরি করা হয়ে থাকে। বর্ষায় প্রকৃতির সতেজ-সজীব রূপ-রস যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয় জয় করে এসেছে।
পরিবেশ ও প্রকৃতি বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক-এর আঞ্চলিক কর্মকর্তা বিমল রায় জানান, কদম ছাড়া বর্ষা বেমানান। সেই কদম ফুলের সৌন্দর্যে যেন দাগ পড়েছে। লাভের অঙ্কের হিসাব মিলাতে মানুষ আর কদম গাছ লাগাতে চাইছে না। কদম গাছের পরিবর্তে দামি কাঠের গাছ রোপণে ঝুঁকছে তারা। তবে প্রকৃতির মাঝ থেকে কদম চিরতরে হারিয়ে গেলেও বাংলা সাহিত্যে রিমঝিম আষাঢ় প্রিয় কদমকে তার চিরসঙ্গী করে রাখবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের পাশাপাশি সামাজিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। ঘিওর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ বিপুল হোসেন জানান, ব্যক্তিপর্যায় ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও সরকারি-বেসরকারি জায়গায় কদম গাছ লাগানো প্রয়োজন। তাহলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement