২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সিপিডির গবেষণা

দেশে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে

স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিল্প খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ চান ব্যবসায়ীরা; কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ নীতি ও সাম্যের পরিপন্থী
-

দেশে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব এখন ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। এই বেকারত্ব কমানোর জন্য চারটি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এগুলো হচ্ছেÑ ভোগ, বিনিয়োগ ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা এবং এর পাশাপাশি নেট রফতানি বাড়ানো। গতকাল ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম’ আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২১-২২ : পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কী থাকছে’ শীর্ষক সংলাপে এ কথা বলেন সংগঠনের আহ্বায়ক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’ (সিপিডি)-এর ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
আলোচনায় অংশ নিয়ে দেশে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বাজেটে শেয়ারবাজার, জমি-ফ্ল্যাট ও ব্যাংকের মতো অনুৎপাদনশীল খাতে ঢালাওভাবে কেন কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তারা বলেছেন, অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা সাদা করার যদি সুযোগই দেয়া হয়, সেটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে দেয়া উচিত। তারা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দেয়া নীতি ও সাম্যের পরিপন্থী। এই সুযোগ দীর্ঘ মেয়াদে হতে পারে না।
অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালের সভাপতিত্বের সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, বিজিএমইএর পরিচালক আসিফ ইব্রাহীমসহ অন্যরা।
ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার কঠোর সমালোচনা করে দেবপ্রিয় বলেন, সৎ করদাতার সাথে এটি অন্যায় আচরণ। সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা থাকলেও সেটিও ভঙ্গ হচ্ছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অর্থনীতির নীতির পরিপন্থী, সাম্যের পরিপন্থী। তিনি বলেন, যে তিনটি খাতে কালো টাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে, সেখান থেকে নতুন কিছু উৎপাদন হয় না। অনুৎপাদনশীল খাতেই এটি বিনিয়োগ হচ্ছে। ৫০ বছরের বাংলাদেশে একটি শ্রেণীর জন্য এই সুযোগ কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
নাসিম মঞ্জুর বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পুরোপুরি অনৈতিক। আমরা যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছি, আমরা ৩০ শতাংশ হারে কর দিচ্ছি। আর যাঁরা কালো টাকা সাদা করছেন, তারা ১০ শতাংশ কর দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। সৎ করদাতাদের কাছে এটি একটি ভুল বার্তা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আমাদের কর দিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ যদি দিতেই হয় সেটি হতে পারে শিল্প খাতে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে।
আসিফ ইব্রাহীম বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দীর্ঘ মেয়াদে কোনো পরিকল্পনা হতে পারে না। রাজস্ব আদায়ের নাম করে এই অনৈতিক সুযোগ বেশি দিন দেয়া ঠিক হবে না।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার মানে হলো করের অন্যায্যতা। করের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।
আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া উচিত সে প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, বাজেট হওয়া উচিত সম্প্রসারণমূলক। আসছে বাজেটে মানুষের ভোগ ব্যয় বাড়াতে হবে। ভোগ ব্যয় না বাড়লে পুষ্টিহীনতা বাড়বে। দারিদ্র্যের হার আরো বাড়বে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে না। সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। একই সাথে নেট রফতানি বাড়াতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার সময়ে শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। শিশুদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগামী বাজেটে শিশু বাজেট করার দাবি জানান তিনি। একই সাথে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ দেন মোস্তাফিজুর রহমান।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, দিনের পর দিন বছরের পর বছর বাংলাদেশে শিক্ষা খাত অবহেলিত রয়ে গেছে। মাধ্যমিকের (এমপিওভুক্ত নয়) হাজার হাজার শিক্ষক অন্য কাজে চলে যাচ্ছেন। তাদের এই পেশায় ধরে রাখতে আগামী বাজেটে কী থাকছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে কত সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, তার তথ্য কেউ জানি না।
শাহীন আনাম বলেন, বাজেটে নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় তা খুবই অপ্রতুল। সেই টাকাও সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কি না, তার নজরদারি হয় না। প্রান্তিক মানুষের জন্য বরাদ্দের টাকা নজরদারি করা উচিত।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, চলমান কোভিড প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটে দেশের প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। একই সাথে কোভিড থেকে পুনরুদ্ধারে বাজেটে ২-৩ বছর মেয়াদি একটি কৌশল নির্ধারণ করা দরকার। অন্যদিকে আগামী বাজেটে নতুন কর আরোপ না-করা এবং কর হার না-বাড়িয়ে প্রশাসনিক দক্ষতা ও কর ফাঁকি রোধের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো প্রয়োজন।
বলা হয়, বর্তমান কোভিড-১৯ অতিমারী বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু দেশের প্রান্তিক এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ওপর এই অতিমারীর অভিঘাত অনেক বেশি। প্রান্তিক মানুষের ওপর অতিমারীর ফলে যে প্রভাব পড়েছে Ñতা সংঘটিত জাতীয় প্রভাবের চেয়ে বেশি। প্রথাগতভাবে যারা আগে বিপন্ন ছিলেন না তারাও এখন যুক্ত হয়েছেন। বিপুলসংখ্যক পরিবার ঋণের জালে পড়েছে এবং তাদের সঞ্চয় হারাচ্ছে। প্রতিবন্ধী, বস্তিবাসী ও চরের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের বাড়তি ব্যয় ও ঋণ পরিশোধে সহায়তা দরকার। বর্তমান কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় আসন্ন জাতীয় বাজেটে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সুস্পষ্ট আর্থিক বরাদ্দ থাকা দরকার এবং একটি নতুন ‘সামাজিক সংহতি তহবিল’ তৈরি করে করপোরেট ও বেসরকারি অনুদানের জন্য আর্থিক উৎসাহ (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে) বিবেচনা করা যেতে পারে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে দেবপ্রিয় বলেন, গত অর্থবছর আমরা এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে পার করেছি। ওই বছর কর আদায়ের হার ও সরকারের ব্যয় কমেছিল। চলতি অর্থবছরেও কর আদায় ও সরকারি ব্যয়ের হার প্রয়োজনের তুলনায় কমেছে। গত মার্চ পর্যন্ত এডিপিতে মোট বরাদ্দের ৪২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ কম। অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ের হার বাড়লেও অর্থবছরের ৯ মাসে লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে।
বাজেট ঘাটতি ৬ শতাংশ কিংবা এর বেশি হলেও তা সহনীয় হতে পারেÑ এমন মত ব্যক্ত করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, তবে বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মেগা প্রকল্পগুলোর পরিবর্তে যেসব প্রকল্প সমাপ্তির পথে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক অর্থায়নের ওপর জোর দিতে হবে। বর্তমানে বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র খাত থেকে সরকারের ঋণ অনেক বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, আগামী বাজেটে নতুন কোনো করারোপ কিংবা কর হার বৃদ্ধি করা উচিত হবে না। প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে কর আদায় বৃদ্ধি এবং কর ফাঁকি কমিয়ে আনতে হবে। যারা কর দেয় না, তাদের কাছ থেকে কর আদায়ের ব্যবস্থ করতে হবে। নিয়মিত করদাতাদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement