আকবরসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমদ নামে এক যুবককে হত্যার ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
অভিযোগপত্রে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত ইনচার্জ পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে। অন্য অভিযুক্তরা হলেন- বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশেকে এলাহি, হাসান উদ্দিন, পুলিশের কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, টিটু চন্দ্র দাস এবং কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। নোমানের বিরুদ্ধে এসআই আকবরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা ও রায়হানকে নির্যাতনের আলামত ধ্বংসের অভিযোগ আনা হয়েছে। গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার কাছে সিলেটের আলোচিত এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রটি দাখিল করে পিবিআই। প্রসিকিউশন শাখা তা ভার্চুয়াল আদালতে উপস্থাপন করবে।
অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান।
তিনি জানান, অভিযোগপত্রভুক্ত ছয়জনের মধ্যে পাঁচ পুলিশ সদস্যই কারাগারে আছেন আর নোমান পলাতক রয়েছেন। এই ঘটনায় তৌহিদ মিয়া নামে আরেক পুলিশ কনস্টেবল গ্রেফতার হলেও সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়নি বলে জানান এসপি।
নগরের আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে তাকে ফাঁড়িতে তুলে আনেন এই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ও তার সহকারীরা। এরপর কয়েক ঘণ্টা চলে নির্যাতন। শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে নিজের চাচাকে ফোন করে রায়হান। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার জন্য চাচাকে অনুরোধ করেন। ভোরে ফজরের নামাজের পূর্ব মূহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন চাচা। তবে তখন তাকে রায়হানের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এরপর ১১ অক্টোবর সকালে আবার চাচা ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে রায়হানের লাশ দেখতে পায় পরিবার।
১১ অক্টোবর রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদি হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে সিলেটজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। অবশেষে প্রায় সাত মাস পর চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করা হলো।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে আকবরের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে
সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমদকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে যেসব আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে বলে জানিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
অভিযোগপত্র জমা দেয়ার পর বুধবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান বলেন, অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২, ৫০১ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫(২), ১৫(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এই দুই আইনের একটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও অপরটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের কথা উল্লেখ আছে। ফলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।
১৯৬২ পৃষ্ঠার এই অভিযোগপত্রে ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে জানিয়ে এসপি বলেন, এর মধ্যে ১০ জন ১৬৪ ধারায় আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। যাদের মধ্যে সাতজন পুলিশ রয়েছেন। তবে রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন পূর্বপরিকল্পিত কিংবা পূর্ববিরোধের জের ধরে নয় বলে দাবি করেছেন এই এসপি।
তিনি বলেন, তদন্তে রায়হান আহমদকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানোর প্রমাণ মিলেছে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ বহিষ্কৃত এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, বহিষ্কৃত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশেকে এলাহি, পুলিশের কনস্টেবল হারুনুর রশিদ ও টিটু চন্দ্র দাস নির্যাতনে অংশ নেন বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। আর নির্যাতনের আলামত নষ্ট ও অভিযুক্তদের পালাতে সহায়তা করেন বহিষ্কৃত এএসআই হাসান উদ্দিন এবং কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। অভিযোগপত্রে এই ৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ফাঁড়িতে রায়হানকে ধরে আনা প্রসঙ্গে এসপি খালেদ উজ জামান বলেন, সাইদুল শেখ নামে এক ব্যক্তির করা ছিনতাইয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে পুলিশ। এসপি বলেন, সাইদুল ইয়াবা সংগ্রহ করতে কাষ্টঘর এলাকায় গিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলাও রয়েছে। সাইদুলের দাবি, ইয়াবা সংগ্রহকালে সেখানে রায়হানের সাথে তার বাগি¦তণ্ডা হয়। সাইদুলের অভিযোগ পেয়ে রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদকালে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে মারা যান।
রায়হানের মা সালমা বেগম প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছেন, অন্য কারো ইন্ধনে পূর্ব পরিকল্পনার জেরে রায়হানকে তুলে এনে নির্যাতন করেছে পুলিশ।
তবে বুধবার এসপি খালেদ উজ জামান বলেন, দীর্ঘ তদন্ত, সবার সাক্ষ্যগ্রহণ এবং রায়হান, আকবরসহ সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোন আলাপ সংগ্রহ করেও আমরা এরকম কোনো প্রমাণ পাইনি। রায়হানকে নির্যাতনের সাথে পূর্ব বিরোধের কিছু পাওয়া যায়নি।
চার্জশিট নিয়ে যা বললেন রায়হানের মা
শুরু থেকেই রায়হান আহমদের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে দাবি করে আসছে তার পরিবার। পুলিশের নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে এমন দাবি করে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আন্দোলনে নামেন রায়হানের মা সালমা বেগম। তার এই আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিলেটে। রায়হানের মৃত্যুর প্রায় সাত মাস পর এই মামলার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশেন (পিবিআই)। বুধবার সকালে জমা দেয়া এই অভিযোগপত্র নিয়ে দুপুরে কথা হয় রাহয়ান আহমদের মা সালমা বেগমের সাথে।
অভিযোগপত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পিবিআই একটি দীর্ঘ অভিযোগপত্র দিয়েছে। এটি পুরোটা এখনো আমি পড়তে পারিনি। এছাড়া আমি একজন সাধারণ গৃহিণী। আইনি সব বিষয় বুঝিও না। এই অভিযোগপত্র নিয়ে আমার আইনজীবীদের সাথে কথা বলব। তাদের পরামর্শ মতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।
সালমা বেগম বলেন, রায়হানকে রাত ১টার দিকে তুলে নেয়। পরদিন সকাল ৭টার দিকে সে মারা যায়। এই ৬ ঘণ্টা ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে তাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। এখানে পূর্ববিরোধ বা তাৎক্ষণিক বিরোধ মুখ্য বিষয় নয়।
রায়হানের মা বলেন, রায়হান অপরাধ করে থাকলে তাকে ধরার পর পুলিশ আমাদের অবহিত করবে। কিন্তু তা না করে শেষরাতে টাকা চেয়ে ফোন করানো হলো। আর রায়হানের মৃত্যুর পর নিজেদের এক দালালের মাধ্যমে আমাদের কাছে খবর পাঠায় পুলিশ। এসব কেনো করা হলো?
সালমা বেগম বলেন, ইয়াবা-ছিনতাইসহ এখন নানা বিষয়কে রায়হানের সাথে জড়ানো হচ্ছে। রায়হান যেহেতু নেই তাই এমন বিষয়ের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব নয়। এখন তো সে আর এসবের প্রতিবাদ করতে পারবে না। ফলে আমাদের দাবি একটাই, রায়হান হত্যার বিচার চাই।