২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানিকগঞ্জের সুগন্ধি মুড়ি

-

ভেজাল মুক্ত হাতেভাজা সুগন্ধি মুড়ি। এই মুড়ির স্বাদ উপভোগ করতে হলে যেতে হবে মানিকগঞ্জের নবগ্রাম ইউনিয়নের ধলাই, উভাজানি, সরুপাই, নবগ্রাম ও দৌলতপুর উপজেলার পূর্বপাড়া গ্রামে। সেখানে পরম মমতায় এই মুড়ি তৈরি হচ্ছে কয়েক যুগ ধরে। ভুসি দিয়ে ধান থেকে তৈরি হয় বড় আকারের মুড়ি। ইফতারিতে ছোট-বড় প্রায় সবারই অন্যতম আকর্ষণ পিয়াজু, ছোলার সাথে সুস্বাদু মুড়ি মাখা। এই মুড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে রাজধানীসহ দেশজুড়ে।
অথচ বাড়িতে স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে হাতেভাজা এসব মুড়ির কারিগরদের টেকা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। কারণ হিসেবে তাদের অভিযোগ, হাইড্রোজ মিশিয়ে মেশিনে ভেজে মুড়ি বড় ও সাদা করে কম দামে বিক্রি করছেন শহরের মুড়ি কারখানার মালিকেরা। এতে খরচ ও পরিশ্রম উভয়ই কম লাগে। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জেনেও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে হাইড্রোজ মিশিয়ে, মুড়ি বড় ও সাদা করে বিক্রি করছেন অসাধু এই ব্যবসায়ীরা। অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন পেশা বদল করতে।
গতকাল শুক্রবার সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার সরুপাই, ধলাই, উভাজানী ও নবগ্রামে তৈরি হচ্ছে হাতেভাজা এই মুড়ি। প্রায় ৪০ বছর ধরে এই গ্রামগুলোতে তৈরি হয় ভেজালমুক্ত হাতেভাজা মুড়ি। মুড়ি তৈরি একমাত্র পেশা তাদের। মুড়ি ভেজেই তাদের জীবিকা চলছে। সংসারের-আয় উন্নতি করেছেন অনেকেই। কিন্তু পুঁজির অভাব ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না হাতেভাজা মুড়ির কারিগররা। বাধ্য হয়ে অনেকেই ছেড়ে দিচ্ছেন এ পেশা। তারা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, মুড়িকে আকর্ষণীয় ও আকারে বড় করতে শহরের ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে ক্ষতিকারক হাইড্রোজ।
ধলাই গ্রামের প্রায় ২০-২৫টি বাড়িতে মুড়িকে ঘিরেই চলছে ব্যস্ততা। কেউ লাকড়ি এগিয়ে দিচ্ছেন, কেউ মুড়ির চাল শুকাচ্ছেন, কেউবা বিশেষ ধরনের মাটির তৈরি চুলায় খোলায় চালে উত্তাপ দিচ্ছেন। গরম বালুর পরশে তা মুড়মুড় করে ফুটে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু মুড়ি। প্রতিটি বাড়িতে মুড়ি তৈরির শব্দ যেন জীবনের ছন্দ জড়িয়ে আছে তাদের।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার পূর্বপাড়া গ্রামের গৃহবধূরা এখন মুড়ি ভাজায় ব্যস্ত সময় পার করছে। তাদের হাতেভাজা মুড়ির দাম বেশি হলেও সুস্বাদু হওয়ায় জেলা শহরের গন্ডি পেরিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে এ মুড়ি। সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার দৌলতপুর পূর্বপাড়া, ঝর্ণা রানী শীল, কালীতারা রাজবংশী, শ্যামলী রানী রাজবংশী, সাধন রাজবংশীর বাড়িতে চলছে মুড়ি তৈরির ধুম। প্রথম রজমান থেকে প্রতিদিন তারা দুই থেকে চার মণ মুড়ি মাটির চুলোয় ভেজে বিক্রি করছে। তারা জানান, বাজারে সার দিয়ে মেশিনে ভাজা মুড়ির দাম কম ও এতে সময় কম ব্যয় হওয়ায় হাতেভাজা মুড়ির বেচাকেনা অনেক কমে গেছে।
চালের সাথে লবণ পানি মিশিয়ে বালু দিয়ে ভেজে এই মুড়ি তৈরি করা হয়। জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে রয়েছে এই মুড়ির ব্যাপক চাহিদা। যারা মুড়ি তৈরি করেন তাদের বিক্রি নিয়ে কোনো ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় না। কারণ পাইকাররা তাদের বাড়ি থেকে এই মুড়ি কিনে নিয়ে যায়। সারা বছর ধরে নারী-পুরুষ মিলেমিশে চালায় পারিবারিক ব্যবসা। মুড়ি ভাজার সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি পরিবার এখন মোটামুটি সচ্ছল। তাদের অনেকের বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। বিশেষ করে যেখানে তারা মুড়ি ভাজার কাজ করেন সেখানের পরিবেশও স্বাস্থ্যসম্মত।
মানিকগঞ্জ-হরিরামপুর সড়ক সংলগ্ন সরুপাই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মনোয়ারা বেগমের বাড়িতে হাতেভাজা ভুসি ভাঙ্গা মুড়ির ম ম গন্ধ। পরিবারের সবাই ব্যস্ত মুড়ি তৈরির কাজে। প্রথম রমজানের দুই এক দিন আগে থেকে প্রতি দিন তারা দুই থেকে চার মণ মুড়ি মাটির চুলায় ভেজে বিক্রি করছেন। পাইকাররা এখান থেকে মুড়ি ক্রয় করে জেলা শহরের বড় বড় দোকানে নিয়ে বিক্রি করে থাকেন। এ ছাড়া এই অঞ্চলের সুস্বাদু মুড়ির কদর এতই বেশি যার ফলে জেলার গন্ডি পেরিয়ে তা চলে যাচ্ছে ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। শুধু আনোয়ারা বেগমের বাড়িতেই নয় এই গ্রামের কমপক্ষে আরো ১২টি বাড়িতে চলছে মুড়ি তৈরির ধুম। আনোয়ারা বেগম বললেন, স্বামীর সংসারে যেদিন পা রেখেছি সেদিন থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি মুড়ি তৈরিতে। ৩৫ বছরের অধিক সময় ধরেই মিশে আছি মুড়ি ভাজার কাজে। মুড়ি তৈরি ও বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা পেয়েছি। আমার বাড়ির হাতেভাজা মুড়ির নাম ডাক অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, হাতেভাজা মুড়ির কদর সব চেয়ে বেশি থাকে রমজান মাসে। এই মাসে প্রতিদিনই পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে মুড়ি কিনে তা শহরে বেশি দামে বিক্রি করে। আমরা যে মুড়ি তৈরি করি তাতে কোনো ধরনের ভেজাল নেই। নেই কোনো রাসায়নিক ক্ষতিকারক পদার্থ। যার কারণে হাতেভাজা মুড়ির চাহিদা বেশি। তবে সারা বছরের চাইতে রোজার সময় এর চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রতি কেজি বিক্রি করি ৯০ থেকে একশ’ টাকা। অনেক কষ্ট হয় তার পরও পূর্ব পুরুষের এই পেশাকে ছাড়তে পারি না।
এ গ্রামের গৃহবধূ রাজিয়া আক্তার বললেন, আমরা এখানে যে মুড়ি ভাজি তার নাম ভুসিভাঙ্গা মুড়ি। হাতেভাজা এই মুুড়িতে নেই কোনো ক্ষতিকর পদার্থ। যে কারণে এই মুড়ির চাহিদা অনেক বেশি।
অপর মুড়ি তৈরির কারিগর মো: ইউনুছ মিয়া হতাশা ব্যক্ত করে জানান, মুড়িকে আকর্ষণীয় ও আকারে বড় করতে ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে ক্ষতিকারক হাইড্রোজ। আর এই অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না তারা। তাই বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন তারা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো: মজনু বিশ্বাস জানালেন, এই গ্রামগুলো মুড়ির গ্রাম হিসেবেই এক সময় পরিচিত ছিল। প্রতিটি বাড়িতে মুড়ি তৈরি করা হতো। নিজ জেলা ছাড়িয়ে ঢাকার পাইকাররা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েন এ এলাকায় তৈরি মুড়ি কিনতে। অনেকেই শখের বশে দেশের বাইরেও হাতেভাজা এই সুগন্ধী মুড়ি নিয়ে যান। একটা সময় বাতাসে ভেসে বেড়াতো মুড়ির সুবাসিত ঘ্রাণ। কিন্তু বর্তমানে বাজারে আধুনিক মেশিন দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে মুড়ি উৎপাদন করায় এখানকার কারিগররা আর্থিকভবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই হাতেভাজা মুড়ি তৈরিতে আগ্রহ কমে যাচ্ছে তাদের।
বিডিএমের অতিরিক্ত মহাসচিব ডা: মো: আবুল হাসান জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম পরিমাণ মুড়িতে রয়েছে ৪০২ গ্রাম ক্যালরি, ৮৯.৮ গ্রাম শর্করা, ০.৫ গ্রাম ফ্যাট, কোলস্টেরল নেই, ৬.৩ গ্রাম প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ৬ মি.গ্রাম, ফসফরাস- ৬ মি.গ্রাম, সোডিয়াম ৩ মি.গ্রাম। মানবদেহের জন্য এই পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ মুড়ি অনেক সহায়ক ও উপকারী। মুড়ির চাহিদা বাড়ার যান্ত্রিক কলে মুড়ি বানানো ক্রমেই বাড়ছে। বিভিন্ন হাটবাজারে রাসায়নিক সার ইউরিয়া ও ফিটকিরি মিশ্রিত মুড়ি অবাধে বিক্রি হচ্ছে। মানুষ নানা রকম অসুখের শিকার হচ্ছে এ ধরনের খাদ্যের কারণেই। হাতেভাজা ভেজালমুক্ত মুড়ি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বানিয়াজুরী বাসস্ট্যান্ড বাজারের মুদি দোকানি মো: গোলাপ খাঁন জানান, গ্রামের হাতেভাজা মুড়ি মানুষের কাছে কদর বেশি। সেখান থেকে ৯০ থেকে ১০০ টাকায় কিনে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। আর রমজান মাসে ইফতারের জন্য এই মুড়ির চাহিদা অনেক বেশি। কারন এই মুড়িতে কোনো ভেজাল নেই।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড আড়তের মুড়ির পাইকারি ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম জানান, ‘রোজার পাশাপাশি বর্তমানে আম, কাঁঠাল বাজারে উঠায় চাহিদা বেড়েছে হাতেভাজা মুড়ির। স্বল্প পুঁজির এ ব্যবসা হলেও প্রতিদিন প্রায় এক লাখ টাকার মুড়ি বিক্রি হয় স্থানীয় এ আড়তে। এ ছাড়াও এসব গ্রাম থেকে ট্রাকে করে রাজধানী ঢাকা ও আশুলিয়ার বিভিন্ন পাইকারি আড়তে চলে যায়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়।


আরো সংবাদ



premium cement
দাউদকান্দিতে পুকুর থেকে মাদরাসাছাত্রীর লাশ উদ্ধার আলমডাঙ্গায় নিখোঁজের ৬ দিন পর মহিলার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার কুমিল্লায় পথচারী ও শ্রমজীবীদের মধ্যে জামায়াতের পানি ও শরবত বিতরণ চুয়াডাঙ্গায় বৃষ্টির জন্য ইস্তিস্কার নামাজে মুসল্লিদের কান্নার ঢল চীনা কোম্পানি বেপজা অর্থনৈতিক জোনে ১৯.৯৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে মৃত মায়ের গর্ভে জন্ম নিলো নতুন প্রাণ দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদ সমাবেশে কেউ মারা যায়নি : পুলিশ সুপার হামাসকে কাতার ছাড়তে হবে না, বিশ্বাস এরদোগানের জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিক নিরাপত্তার উদ্যোগ ভালো লেগেছে : সীতাকুন্ডে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১০ দেশের অংশগ্রহণে সামরিক মহড়া শুরু করল আরব আমিরাত গাজা থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের পর ২ হাজার ফিলিস্তিনি নিখোঁজ

সকল