২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর দাফন সম্পন্ন

-

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নব নির্বাচিত সভাপতি, সাবেক আইনমন্ত্রী, কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) সংসদীয় আসন থেকে পাঁচবারের নির্বাচিত এমপি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু এমপি’র (৭১) দাফন গতকাল বৃহস্পতিবার সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা ও কুমিল্লার পাঁচটি স্থানে নামাজে জানাজা শেষে বিকালে রাস্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মীরপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে।
আব্দুল মতিন খসরু করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বুধবার (১৪ এপ্রিল) বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহে রাজিউন)। তাঁর মৃত্যুতে কেন্দ্রীয়, জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন ছাড়াও সকল মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গণে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অংশ নেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো: আশরাফ আলী খান খসরু, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কামাল হোসেন, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন প্রমুখ। এ ছাড়া অংশ নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, সিনিয়র আইনজীবী, আইনজীবী ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা। জানাজার আগে আবদুল মতিন খসরুর ছেলে আবদুল মুনায়েম ওয়াসিফ তার বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চান। জানাজা শেষে এ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। পরে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের পক্ষ থেকে তার কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নিয়ে, ডেপুটি স্পিকারের পক্ষে, আওয়ামী লীগের পক্ষে মাহবুব উল আলম হানিফ, আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, আবদুল মতিন খসরু অ্যাসোসিয়েটস ও ঢাকা আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এর আগে সকাল ৮টার দিকে আবদুল মতিন খসরুর নিজ বাসভবন এলাকা বকশীবাজারে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ বন্ধ : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে তার প্রতি সম্মান জানিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে ভার্চুয়ালি বিচারকার্য পরিচালিত হয়নি। বৃহস্পতিবার অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকাজ বন্ধ রাখার জন্য প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ জানান। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আপিল বিভাগের সব বিচারপতির সাথে এ বিষয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। সব বিচারপতি একবাক্যে বলেছেন কোর্ট বন্ধ রাখার জন্য। কোর্ট বসবে না। এ সময় বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এমন সিদ্ধান্তের জন্য আইনজীবীদের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
শোক : আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পৃথক পৃথক শোকবার্তায় তারা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এ ছাড়া আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আহ্বায়ক প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি তার রূহের মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। বাংলাদেশ জাতীয় আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহ মো: খসরুজ্জামান ও সেক্রেটারি জেনারেল মো: সগীর আনোয়ার এক শোকবাণীতে বলেন, তিনি জাতীয় আইনজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যুতে আইনাঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে আরো শোক প্রকাশ করেছেন অর্থ মন্ত্রী ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপি, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এমপি, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক এমপি, কুমিল্লা সদর আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন, চান্দিনার এমপি অধ্যাপক আলী আশরাফ, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি আঞ্জুম সুলতানা সীমা, মুরাদনগরের এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন, দেবিদ্বারের এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এমরান কবির চৌধুরী, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আবদুছ সালাম, কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান, পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন স্বপন, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আবু জাহের সরকার, বুড়িচং উপজেলা চেয়ারম্যান আখলাক হায়দারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১৬ মার্চ সকালে সিএমএইচে ভর্তি হন আবদুল মতিন খসরু। তবে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ২৫ মার্চ রাতে আইসিইউতে নেয়া হয় তাকে। পরে তার শারীরিক অবস্থায় উন্নতি হওয়ায় ৩১ মার্চ বুধবার কেবিনে দেয়া হয়। এরপর তার করোনা পরীক্ষা করা হয়। গত ১ এপ্রিল করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। কিন্তু হঠাৎ করে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ৬ এপ্রিল তাকে ফের আইসিইউতে নেয়া হয়। মঙ্গলবার আবদুল মতিন খসরুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।
গত ১২ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে (২০২১-২২) ঘোষিত ফলাফলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ (সাদা প্যানেল) থেকে সভাপতি পদে জয়ী হন আবদুল মতিন খসরু। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৯১ সালে কুমিল্লা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল মতিন খসরু। তার পর ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে মোট পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে সপ্তম সংসদে (১৯৯৬-২০০১) আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান সংসদে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তিনি। আবদুল মতিন খসরু ১৯৯৬ সাল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং তার সময়েই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়, যা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের পথ উন্মুক্ত করে।
দাফন: কুমিল্লা ও বুড়িচং সংবাদদাতা জানান, সুপ্রিম কোর্টে দ্বিতয়ি জানাজার পর আবদুল মতিন খসরুর লাশ কুমিল্লায় নিয়ে আসা হয়। বাদ জোহর বুড়িচং উপজেলা সদরের আনন্দ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ৩য় জানাজা, বিকালে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ভগবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ৪র্থ জানাজা এবং সর্বশেষ বাদ আসর ওই উপজেলার মীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ৫ম জানাজা শেষে রাস্ট্রীয় মর্যাদায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের মাধ্যমে এই রাজনীতিকের জীবনের একটি অধ্যায়ের শেষ হয়।
বর্ষিয়ান এ নেতার লাশ কুমিল্লায় নিয়ে আসার পর একনজর দেখার জন্য দল ও দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও নানা শ্রেণিপেশার শত শত মানুষের ঢল নামে। করোনার কঠোর লকডাউন উপেক্ষা করে তাঁর নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণ করে তাঁরা। এসময় জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আবদুল মতিন খসরু ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ সালে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মিরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হাজী মো: আবদুল মালেক ও মা জাহানারা বেগম। তিনি চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়েটি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে কর্মরত আছেন এবং ছেলে আর্কিটেট পেশায় নিয়োজিত। আবদুল মতিন খসরু ১৯৭৮ সালে কুমিল্লা জজকোর্টে যোগ দেন এবং ১৯৮২ সালের ১৩ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১০ সালের ২৪ আগস্ট তিনি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।

 


আরো সংবাদ



premium cement