২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
নারায়ণগঞ্জে লঞ্চ ডুবে ৩৪ জনের মৃত্যু

শিপ সার্ভেয়ারকে বাঁচাতে মরিয়া একটি পক্ষ

-

নারায়ণগঞ্জে লঞ্চ ডুবিতে হতাহতের ঘটনায় শিপ সার্ভেয়ার শাহরিয়ার হোসেনকে বাঁচাতে একটি পক্ষ মাঠে নেমেছে। যেকোনো উপায়ে তারা শিপ সার্ভেয়ারকে বাঁচাতে চায়। লক্কড়ঝক্কড় ওই নৌযানটি চলাচলের অনুপযুক্ত হলেও সেটির ফিটনেস সনদ দিয়েছিলেন এই শাহরিয়ার।
৪ এপ্রিল রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ এলাকায় নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছে এসকেএল-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল সাবিত আল হাসান নামের নৌযানটি ডুবে যায়। ওই দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৪ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পরের দিন বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক বাবুলাল বৈদ্য অজ্ঞাত জাহাজটির বিরুদ্ধে বন্দর থানায় একটি মামলা করেন। এই ঘটনায় কার্গো জাহাজটিকে আটক এবং ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কার্গো জাহাজটি আটক হলেও চলাচলে অনুপযুক্ত এমএল সাবিত আল হাসান লঞ্চটিকে যারা ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়েছেন তারা এখনো বহাল তবিয়তে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, দুর্ঘটনার সব দায় কার্গো জাহাজটির ওপর চাপিয়ে দিয়ে ডুবে যাওয়া ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ এমএল সাবিত আল হাসানকে সার্ভে (ফিটনেস সনদ) প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট শিপ সার্ভেয়ারকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য একটি মহল অপচেষ্টা চালাচ্ছে। লক্কড়ঝক্কড় এই লঞ্চকে ফিটনেস সনদ দিয়েছেন নৌপরিবহন অধিদফতর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার মো: শাহরিয়ার হোসেন। তিনি লঞ্চের সনদধারী মাস্টারকে সশরীরে না দেখেই চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, মো: শাহরিয়ার হোসেন কয়েক মাস আগে পরিদর্শন ছাড়াই এমভি গোলাম রহমান (নিবন্ধন নম্বর এম-৭২৪১) নামে একটি কার্গো জাহাজের সার্ভে সনদ দিয়েছিলেন। অথচ জাহাজটি ২০১৮ সালে মেঘনায় দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ডুবে যায় এবং পরবর্তী সময়ে মালিক জাহাজটি উত্তোলন করেননি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি শীর্ষ স্থানীয় জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর আলোড়ন সৃষ্টি হলে জাহাজটির সার্ভে সনদ বাতিল করা হয়। তবে ভৌতিক জাহাজের সার্ভে দেয়া সত্ত্বেও অদৃশ্য কারণে অভিযুক্ত শাহরিয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মো: শহীদ মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনার পর কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে এবং কমিটিগুলো কাজ করছে। এই মুহূর্তে আগাম মন্তব্য করা সমীচীন নয়। বড় কার্গো জাহাজটি ছোট একটি লঞ্চকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে, এটাই যে দুর্ঘটনার একমাত্র কারণÑ তা এখনো প্রমাণিত হয়নি। যাত্রীবাহী লঞ্চটি চলাচলের উপযুক্ত এবং এর সব কাগজপত্র সঠিক ছিল কি না, লঞ্চে দক্ষ মাস্টার ও ড্রাইভার ছিলেন কি না, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লঞ্চটিকে ফিটনেস সনদ দেয়া হয়েছিল কি নাÑ এর সবকিছুই পরিষ্কার হবে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর। নৌ নিরাপত্তার স্বার্থে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের দাবি জানান তিনি।
একাধিক বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি যেভাবেই ঘটুক না কেনÑ দুর্ঘটনাকবলিত সব ক’টি নৌযানকেই তদন্তের আওতায় আনতে হবে। এগুলোর অবকাঠামো পরীক্ষাসহ সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে ছোট লঞ্চ ‘এমএল সাবিত আল হাসান’ ডুবে গিয়ে ব্যাপক প্রাণহানির মূল কারণ যদি ‘এসকেএল-৩ কার্গো জাহাজের ধাক্কা’ই হয় তাহলেও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের স্বার্থে ডুবে যাওয়া লঞ্চটির মাস্টার ও ড্রাইভারের সনদ ও নকশা, বুকলেট ও অবকাঠামো নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তারা।
গত ৮ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জ থেকে ১৪ জন শ্রমিক-কর্মচারীসহ এসকেএল-৩ নামের জাহাজটি আটক করেছে কোস্টগার্ড। ওই মামলায় তাদেরকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হলে বিচারক পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিন করে পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করে এবং অন্য ৯ জনকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। এসকেএল-৩ জাহাজের শ্রমিক-কর্মচারীরা বলেছেন, আটক এড়াতে তারা মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন ডকইয়ার্ডে নিয়ে জাহাজটির রঙ বদল করেছেন। জানতে চাইলে থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন ডকইয়ার্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এসকেএল-৩-এর মাস্টার ও অন্য কর্মচারীদের বক্তব্য মোটেও সঠিক নয়। জাহাজটি তাদের ডকইয়ার্ডে আনা হয়নি।
দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে এ পর্যন্ত চারটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আবদুছ ছাত্তার শেখকে আহ্বায়ক এবং বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে সাত সদস্যের কমিটি করেছে নৌ মন্ত্রণালয়। নৌ অধিদফতরের ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার এহতেসানুল হক ফকিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি করেছে নৌ পরিবহন অধিদফতরের যার অপর দুই সদস্য হলেনÑ অধিদফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শামীম আরা ও পরিদর্শক মো: হাবিবুর রহমান। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরী ববির নেতৃত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করেছে। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) মো: রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিআইডব্লিউটিএ।


আরো সংবাদ



premium cement