২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
রেলের প্যাসেঞ্জার কোচ সংগ্রহ

বাড়তি দরে ৪৭ কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে

কোচ কিনতে শিক্ষা সফরে খরচ ৮৪ লাখ টাকা; চালানোর প্রশিক্ষণ খাতে খরচ ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা
-

উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ক্রয় কার্যক্রমে পণ্যমূল্য প্রস্তাবনার ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলছে। ফলে রাষ্ট্রকে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। আর দুই প্রস্তাবনার দামের ব্যবধানের কারণে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে। অন্য দিকে সমজাতীয় প্রকল্পের চেয়ে এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা থেকে সোয়া দুই কোটি টাকা বেশি দরে রেলওয়ের জন্য যাত্রী কোচ কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এই বাড়তি দরে রেলের জন্য যাত্রী কোচ কেনা হলে রাষ্ট্রকে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে। রেলের ২০০টি ব্রডগেজ প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ বা যাত্রী কোচ কেনার জন্য যে প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে এই চিত্র পাওয়া গেছে। আর এই কোচ কেনার জন্য ৮৪ লাখ টাকা খরচ করে শিক্ষা সফরে যাবেন কর্মকর্তারা। আর এসব কোচ চালানোর প্রশিক্ষণেই খরচ হবে দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এইসব খরচের ক্ষেত্রে আপত্তি পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের।
রেল মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ২০০টি ব্রডগেজ কোচ কিনবে। এই প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৭৩৫ কোটি ৯৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এখানে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (ইআইবি) ঋণ হলো এক হাজার ৩৫৫ কোটি ৯৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে ৩৭৯ কোটি ৮৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। চলতি বছর অনুমোদন পেলে আগামী ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই ২০০টি কোচ সংগ্রহ করা হবে। ইআইবির সাথে গত ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে তারা মোট ৩২ কোটি ৭১ লাখ ইউরো দেবে। নিজস্ব তহবিল থেকে দিতে হবে পাঁচ কোটি ১১ লাখ, ইআইবি ঋণ ১১ কোটি এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ ১৬ কোটি ৬০ লাখ ইউরো। এখানে ইআইবির ১১ কোটি ইউরো দিয়ে ২০০টি ক্যারেজ ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে রেলওয়ে জানায়।
এ দিকে রেলের দেয়া বিভিন্ন ক্যারেজের দাম হলো, ক্যারেজ এক সেট (চারটি) ২৮ কোটি ২৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা। বিজি ইন্সপেকশন কার প্রতিটি সাত কোটি দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা, বিজি স্যালোন প্রতিটি আট কোটি ১৬ লাখ পাঁচ হাজার টাকা, বিজি শীততাপ স্লিপার কার প্রতিটি পাঁচ কোটি ১০ লাখ ৮২ হাজার টাকা, বিজি শীততাপ চেয়ার কার প্রতিটি চার কোটি ৭০ লাখ ৯২ হাজার টাকা, বিজি শোভন চেয়ার কোচ পেনট্রিসহ প্রতিটি চার কোটি ১৮ লাখ ১৮ হাজার টাকা, বিজি শোভন চেয়ার কার নামাজের ঘরসহ প্রতিটি চার কোটি ১০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, পাওয়ার কার ও হার্ডব্রেকসহ বিজি শীততাপ কোচ প্রতিটি পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা।
পিইসির ব্যয় পর্যালোচনায় এবং অন্য প্রকল্পের সাথে তুলনায় থেকে দেখা যায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ব্রডগেজ যাত্রী কোচ প্রতিটি ইউনিটের দর পড়ছে ছয় কোটি ৩৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা। আবার পিইসি সভায় ডিপিপি সংশোধনের জন্য বলা হলে এখন দর দেখানো হয়েছে ছয় কোটি ৫৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। ফলে এখানে দুই ডিপিপির মধ্যে দর ব্যবধান ২৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এই দর ব্যবধানে ২০০টির জন্য বাড়তি ৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা লাগবে। আর সমজাতীয় চলমান ২০০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ যাত্রী ক্যারেজ ক্রয় প্রকল্পে প্রতি ইউনিটের দর চার কোটি ৬০ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এটার সাথে গড় দর ব্যবধান হলো এক কোটি ৭৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। ফলে ২০০টি কিনতে হলে সরকারকে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে। এই দর নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে। অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে আপত্তি তোলে ভৌত অবকাঠামো বিভাগ। যা পিইসি প্রথম সভার কার্যপত্রে উঠে এসেছে। নতুন পিইসি সভার কার্যপত্রেও বলা হয়েছে প্রথম ডিপিপির তুলনায় সংশোধিত ডিপিপিতে প্রতিটির দর ২৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকার বেশি।
চীনের বিভিন্ন কোম্পানির ওয়েবসাইটে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, জিয়ানসগু নিউয়ার ট্রেন টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেড বিভিন্ন মডেল ও স্পেসিফিকেশনের রেল কোচ তৈরি করছে। তাদের কোম্পানির ১২০ কিলোমিটার গতির প্রতিটি কোচের দাম ৮০ হাজার থেকে সাড়ে ছয় লাখ মার্কিন ডলার। ৮৫ টাকা বিনিময়মূল্য ধরলে প্রতিটির সর্বোচ্চ মূল্য পড়বে পাঁচ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এটা ফ্রেম বডির। আর সুজহু ইস্ট রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ টনের ১০০ কিলোমিটার গতির কোচের দাম তিন লাখ ডলার রয়েছে। সেখানে এই দাম স্থানীয় মুদ্রায় দুই কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এসব দর ট্যাক্স ও ভ্যাট ছাড়া।
পিইসির তথ্য মতে, প্রস্তাবিত দর এলওসি (ভারতীয় ঋণ) আওতায় কোচ কেনা প্রকল্পে দরের সাথে প্রতি বছর তিন শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিজনিত ব্যয় ধরে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এটি না করে এডিবির সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পকেই প্রস্তাবিত দরের ভিত্তি হিসেবে ধরা যেতে পারে।
সূত্র জানায়, এডিবির ঋণে ৫০টি ব্রডগেজ কোচ কেনার প্রকল্প চলমান আছে। ২০১৭ সালের জুনে কোচগুলো কেনার চুক্তি সই করে রেলওয়ে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা প্রতিটি মিটারগেজ কোচের মূল্য তিন কোটি তিন লাখ টাকা এবং প্রতিটি ব্রডগেজ কোচের মূল্য চার কোটি ২২ লাখ টাকা। আমদানি করা মিটারগেজ কোচের ১৮টি এসি বার্থ বা প্রথম শ্রেণীর এসি সিøপারযুক্ত কোচ থাকবে ১০টি। ৫৫ সিটবিশিষ্ট এসি চেয়ার কোচ থাকবে ৪০টি। ৬০ সিট বিশিষ্ট শোভন চেয়ার কোচ থাকবে ১১২টি। ১৫ সিটবিশিষ্ট খাবার গাড়ি ও গার্ড ব্রেকসহ কোচ থাকবে ২৫টি। পাওয়ার কার ও নামাজ ঘরসহ কোচ থাকবে ১৩টি। দেশে এই প্রকল্পের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো স্টেনলেস স্টিলের বডি ও বায়ো টয়লেটযুক্ত কোচ আনছে রেল কর্তৃপক্ষ। ভেতরে কোচের আয়তনও বর্তমান ট্রেনের চেয়ে বেশি বলে যাত্রীরা অধিক স্থানে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে সক্ষম হবেন। একই সাথে এসব ট্রেন সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব ও আরামদায়ক তথা যাত্রীবান্ধব।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলওসিতে সীমিত দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে ভারতীয় কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ অংশ নিতে পারে না। তাই কোচের দাম কিছুটা বেশি পড়বেই। আর ইআইবির ঋণে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। এডিবির মতো এ ক্ষেত্রেও দর কম হবে। তাই পরিকল্পনা কমিশন থেকে আপত্তি তুলেছে।
রেলের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে রেলের ৪২৮টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ আছে। এর মধ্যে ১৮৭টির আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। মাস্টারপ্লান অনুযায়ী আগামী ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে রেলের সব ট্র্যাক ব্রডগেজে রূপান্তর করা হবে। এ ছাড়া যমুনা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে এবং পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প সম্পন্ন হলে সারা দেশে ব্রডগেজ ট্রেনের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এ জন্য পুরনো কোচগুলো প্রতিস্থাপনসহ আগামী দু-চার বছরের মধ্যে নতুন ৪০০ কোচ দরকার হবে। তাই নতুন কোচগুলো কেনা জরুরি বলে ডিপিপিতে উল্লেখ করেছে রেলওয়ে।
এ দিকে রেলওয়ের প্রকল্পের কোচের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে সংশ্লিষ্টরা জানান, মিটারগেজ ও ব্রডগেজ কোচ আনা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া থেকেই এসব কোচ আসছে।
আমদানিকৃত এসব কোচের মূল্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, এগুলো সবই আধুনিক ও অটোমেটিক। সর্বশেষ মডেলগুলোই আনা হচ্ছে। ওজনের ভিন্নতা আছে কোচগুলোর। দামের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোচের বিভিন্নতা রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, এখন যেসব কেনা হচ্ছে তা ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা হচ্ছে। তারা কম দরদাতা বলে সেখান থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে।
প্রকল্পে বিভিন্ন ক্রয়ের ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের কাছে সম্প্রতি জানতে চাওয়া হলে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, এলওসিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে দেশের এলওসি সে দেশেরই ঠিকাদারদেরকে কাজ দেয়া হয়। ফলে দর যাচাই করার তেমন কোনো সুযোগ থাকে না। আর ইআইবির ঋণে যেসব ক্রয় কার্যক্রম হয় তাতে উন্মুক্ত দরেই ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়। কারণ তাদের অনেক সদস্য আছে। তিনি বলেন, উন্মুক্ত দরের পর সর্বনিম্ন বিডে যে দর আসবে সেটার পরই যাচাই করা দরকার। আর এসব প্রকল্প যাচাই করেই পিইসির অনুমোদন দেয়া দরকার। তাহলে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হবে।


আরো সংবাদ



premium cement