কলাপাড়ায় অপরূপ জাদি পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়
- এইচ এম হুমায়ুন কবির কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
- ০৬ মার্চ ২০২১, ০০:৪৬
প্রকৃতির সাথে পুরাকীর্তি যাদের সমানভাবে আকর্ষণ করে তাদের আসতে হবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার খাপড়াভাঙ্গা গ্রামে (বর্তমান ডাবলুগঞ্জ) ইউনিয়নে। মধ্যযুগীয় নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গোটা কলাপাড়া উপজেলাজুড়ে। এমনই এক পুরাকীর্তির নাম কাপড়া জাদি (খাপড়াভাঙ্গা মঠ-মন্দির)।
১৮৮৫ সালে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি গড়ে তোলার পরে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন জাদি (মঠ-মন্দির)। উপজেলা সদর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের খাপড়াভাঙ্গা গ্রামে এর অবস্থান। প্রায় ১৩৬ বছরের পুরনো ৪৭ ফুট উচ্চতা ও ১৭ ফুট ২ ইঞ্চি পাশ এবং উচ্চতা একটি বড় গম্বুজ ও চারটি ছোট গম্বুজ ফলক খচিত পিরামিড আকৃতির এই জাদি (মঠ-মন্দির) প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে। তবে জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় এই ঐতিহাসিক জাদি (মঠ-মন্দির) দ্রুত সংরক্ষণ করা না হলে একটি জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে, যা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এক সময় ভক্তদের আনাগোনায় মুখরিত থাকত ওই এলাকাজুড়ে। ঐতিহাসিক এই নিদর্শন সংস্কার না করায় জরাজীর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। আগে ভেতরে কাঠের ও পাথরের অসংখ্য মূর্তি ছিল। ওই সবের একটিও নেই। নেই কোনো দরজা। মন্দিরটি জীর্ণদশার শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পলেস্তরাসহ ইটের গাঁথুনি খসে পড়ছে। চার দিকে পুরনো ইট-সুরকি ধুলির মতো উড়ে যাচ্ছে। ভেঙে বেরিয়ে গেছে লাল ইটের গাঁথুনি। মন্দিরটি ফেটে ফেটে গেছে। দূর থেকে কোনো এক প্রাণীর কঙ্কালের মতো দেখা যায়। এখন ধসে পড়া সময়ের ব্যাপার। মঠ-মন্দিরের চার পাশ বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছে সয়লাব হয়ে ঢেকে গেছে। মঠ-মন্দিরের কাছাকাছি গেলে মানুষের শরীর ছমছম করে ওঠে। এক ধরনের ভৌতিক অবস্থায় শিহরণ জাগে মনের মধ্যে। আগে মঠ-মন্দিরটির আশপাশে সাপ দেখতে পায় বলে জানায় পাশে থাকা মুসলিম বাসিন্দারা। মঠ-মন্দিরের আশপাশে ছিল রাখাইনদের বাড়িঘর- রাখাইনপাড়া। রাখাইনদের ওই জায়গায় কোনো বাড়িঘর এখন নেই। শুধু রয়ে গেছে স্মৃতির মঠ-মন্দিরটি। মঠ-মন্দিরে মঠের স্বর্ণের একটি প্রলেপ ছিল। সেটি ঢাকা ছিল লাল রঙের জরি লাগানো কাপড় দিয়ে। সেটিও চুরি হয়ে গেছে। প্রাচীন এই মন্দির দেখতে এখনো পর্যটক আসেন এখানে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের বাগেরহাট জাদুঘরের কস্টোডিয়ান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের খুলনা বিভাগীয় অফিসের একটি টিম ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ওই এলাকা পরিদর্শন করে চূড়ান্ত একটি প্রতিবেদন প্রস্তাবনা আকারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছেন বলে তখন জানিয়েছিলেন ওই টিমের প্রধান খুলনা অফিসের সহকারী গবেষক গোলাম ফেরদৌস বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ছিল রাখাইন জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্য ধরে রাখার লক্ষ্যেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আর বৌদ্ধ মন্দিরটির স্বকীয়তা বজায় রেখে সংস্কার করলে এখানে দেশী-বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটবে। বাংলাদেশে এই আদলের আরেকটি জাদি (মঠ-মন্দির) রয়েছে রামুতে।
ভারতের বিহারের বৈদ্যগয়ার সম্রাট অশোকের আমলে প্রতিষ্ঠিত কিছু মন্দিরের সাথে এ মন্দিরের সাদৃশ্য রয়েছে। ২০১২ সালে মঠ-মন্দিরটির চার দিকে বেড়া দেয়া ছিল। একটি সাইন বোর্ড টানানো ছিল। ওই সাইন বোর্ডটিতে লেখা ছিল খাপড়াভাঙ্গায় মন্দিরটি সংস্কার ও দেখা শোনার দায়িত্বে রয়েছেন বজন্ত প্রঞ্জাবংশ মহাথেরো। তিনি চট্টগ্রামের ডাবলমুড়িং উপজেলার মোগলতুলি গ্রামের শাখ্যমান বৌদ্ধ বিহার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। এখন বাঁশের বেড়া কিংবা ওই সাইন বোর্ড কিছুই নেই।
এলাকাবাসীর মতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মঠ-মন্দির সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে সনাতন ধর্মাবলম্বীয়সহ সব মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান ও দেশের আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। নচেৎ আদিবাস রাখাইন সম্প্রদায়ের কলাপাড়া উপকূলীয় জনপদের ইতিহাস-ঐতিহ্য এক সময় হারিয়ে যাবে।
পটুয়াখালী ও বরগুনার রাখাইন সম্প্রদায় ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সম্মিলিতভাবে জাদি (মঠ-মন্দিরটি) সংস্কারমূলক এবং বর্তমানে বন জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ পরিচালনা দায়িত্ব পালন করেন মং চোথিন তালুকদার। তিনি বলেন, সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মঠ-মন্দির সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে সনাতন ধর্মাবলম্বীয়সহ সব মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান ও দেশের আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। মঠ-মন্দির দেখতে প্রতিদিন পর্যটকের আগমন ঘটবে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, মঠ-মন্দির পরিষ্কারের জন্য রাখাইনরা এসেছিল। তাদের বন-জঙ্গল পরিষ্কারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুরনো বৌদ্ধরটি কিভাবে রক্ষা করা যায় তার জন্য সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মুতাসিম বিল্লাহ নাসির বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর যেহেতু এর সংরক্ষণের জন্য নির্দেশিত প্রতিষ্ঠান, তাই তাদেরই এটি রক্ষণাবেক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে, দক্ষিণ অঞ্চলে সামুদ্রিক লবণাক্ততার কারণে এমনিতেই এ ধরনের স্থাপনা বেশি দিন টিকে থাকে না, তবুও এটি এখনো টিকে আছে, সার্বিক বিবেচনায় অধিদফতরকে এর রক্ষণাবেক্ষণে তড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের বাগেরহাট জাদুঘরের কস্টোডিয়ান (বর্তমানে ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত মো: গোলাম ফেরদৌস বলেন, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলাস্থ খাপড়াভাঙ্গা গ্রামে মঠবাড়ী নামে খ্যাত কাপড়া জাদি বৌদ্ধ মন্দির পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ ও স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের অংশ হিসেবে এ মন্দিরটি নিঃসন্দেহে সংরক্ষণের দাবি রাখেন। তিনি আরো বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক নির্দেশে আমি প্রথম ২০১২ সালে সরেজমিনে পরিদর্শন করে সংরক্ষণের প্রস্তাব দেই। ২০১৯ সালে পটুয়াখালীর পুরার্কীতি জরিপ ও অনুসন্ধান চলাকালে এটি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তিনি মনে করেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে একে যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে পর্যটন সমৃদ্ধ কুয়াকাটার পর্যটনের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় সম্ভাবনাময় পর্যটন সমৃদ্ধ এই এলাকার আরো প্রসার ঘটবে।