২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডের পুরোভাগে কেন বাংলাদেশ

বিবিসির প্রতিবেদন
-

এ বছর দিল্লির রাজপথে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে পুরোভাগে ছিল বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। বাংলাদেশের ১২২ জনের একটি কনটিজেন্ট ভারতে ২৬ জানুয়ারির সেই প্যারেডে অংশ নেয়, ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ গানের তালে তালে অর্কেস্ট্রাও বাজিয়ে শোনায় সে দেশের সামরিক ব্যান্ড। কুচকাওয়াজের সময় রাজপথের আকাশে ফ্লাই পাস্ট করে যায় একটি ভিন্টেজ ‘ডাকোটা’ বিমানÑ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে যে এয়ারক্র্যাফটের আত্মীয়তাও ছিল নিবিড়। বিবিসির এ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা জহয়, ভারতের সেনাবাহিনীর সূত্রে বলা হচ্ছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সমগ্র ভারত এ বছর যে ‘স্বর্ণিম বিজয় জয়ন্তী’ উদযাপন করছে, সেই উপলক্ষেই এবার প্রজাতন্ত্র দিবসে বাংলাদেশকে এই বিশেষ সম্মান অর্পণ করা হলো। প্রজাতন্ত্র দিবসের ধারাবিবরণীতেও বলা হয়, ‘টুগেদার উই ফট, টুগেদার উই ওয়ান’ - অর্থাৎ আমরা একসাথে লড়েছি, একসাথে যুদ্ধ জিতেছি। বস্তুত গত ৫০ বছরের মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশের সেনারা ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নিলো। কোনো বিদেশী সামরিক বাহিনীর ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের এই উৎসবে যোগদানের ঘটনাও এই নিয়ে মাত্র তৃতীয়বার। কিন্তু ভারতে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা যে বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করে নানা সময়ে নানা বিবৃতি দিয়েছেন, সেই দলের সরকার কেনই বা হঠাৎ বাংলাদেশকে এই বিরল স্বীকৃতিতে সম্মানিত করল? বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জি মনে করেন, এটা আসলে ভারতের পররাষ্ট্র নীতিরই একটা ‘প্যারাডক্স’ বা হেঁয়ালি। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘মুশকিল হল ভারতের পররাষ্ট্র নীতিটাই দুর্বোধ্য। আজ হয়তো বাংলাদেশ সগৌরবে রিপাবলিক প্যারেডে নেতৃত্ব দিচ্ছে, আবার কালকে হয়তো অমিত শাহ্ বাংলাদেশীদের সম্পর্কে এমন একটা কথা বললেন যাতে সবটাই আবার মাটি হয়ে গেল।’ তবে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে দু’দেশের মধ্যে যে ‘চরম আবেগের বন্ধন’ আছে, তা বর্ষীয়ান এই কূটনীতিবিদ কখনোই অস্বীকার করেননিÑ কিন্তু সেই বন্ধনকে ‘অতিরঞ্জিত করার চেষ্টাও অনুচিত’ বলে তার অভিমত।
দেব মুখার্জির কথায়, ‘এই যে বাংলাদেশের কনটিজেন্ট এসে আমাদের জাতীয় প্যারেডে অংশ নিল, দু’দেশের মৈত্রীর ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই বিরাট অর্জন। আমি তার গুরুত্বকে কখনোই ছোট করে দেখব নাÑ কিন্তু আমি এটাকে ভিত্তি করে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, এটাকে নিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কোনো বড়াই করতে চাই না। আর বড় প্রতিবেশী হিসেবে এখানে দায়িত্বটা ভারতের ওপরই বর্তায় বলে আমি বিশ্বাস করি।’
দিল্লিতে সিনিয়র কূটনৈতিক সংবাদদাতা নয়নিমা বসুও বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশকে এই স্বীকৃতি দেয়াটা ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু একাত্তরের স্মৃতিটাকে ভারত একটু বেশি বেশি করে দেখাতে চাইছে তেমন ধারণা সৃষ্টি হলে তা কিন্তু হবে বিপজ্জনক। ‘দ্য প্রিন্ট’ পোর্টালের এই ডিপ্লোম্যাটিক সম্পাদকের কথায়, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বের করে দেয়াই বলুন বা ভারতের হাতে তুলে দেয়াÑ এই বাংলাদেশ সরকার যেভাবে ভারতকে সাহায্য করেছে তার তুলনা হয় না। ফলে সহযোগিতাটা পারস্পরিক। অন্য দিকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের পর দিল্লিতে ইদানীং একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে যে বাংলাদেশ বোধ হয় পাকিস্তানের সাথেও নতুন করে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। ফলে এই যে রিপাবলিক ডে প্যারেডে বাংলাদেশকে বিরল একটা সম্মান দেয়া হলো, সেই পদক্ষেপকে এই পটভূমিতেই দেখতে হবে। এই পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই আমরা একসাথে যুদ্ধে জিতেছি, সেটাও আরো একবার মনে করিয়ে দেয়া হলো আর কী। বিবিসিকে এসব বলেন নয়নিমা বসু। তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ‘তাস’টা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতকে একটু সংযত ও সাবধানী থাকতে হবে বলেই তার বিশ্বাস।
ভারতের বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার চিফ মার্শাল অরূপ রাহা আবার বিশ্বাস করেন, সামরিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সেটিকে মহাসমারোহে উদযাপন করার মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য খুঁজতে যাওয়া একেবারেই অর্থহীন। তিনি বিবিসিকে বলেন, সত্যি কথা বলতে যেভাবে বাংলাদেশের কনটিজেন্ট আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে অংশ নিলো ও ডাকোটা বিমান দিয়ে ফ্লাইপাস্ট করা হলো তাতে আমি অভিভূত। মুক্তিযুদ্ধে এই ডাকোটা এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। মূলত ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্র্যাফট হলেও একাত্তরের ডিসেম্বরে টাঙ্গাইল প্যারা ড্রপ অপারেশনেও ডাকোটা ব্যবহার করা হয়েছিলÑ যে অভিযান খুলে দিয়েছিল ঢাকা দখলের পথ।
ফলে ভারতের বিমানবাহিনীর এই সাবেক প্রধান সেনানী মনে করেন, ডাকোটা ফ্লাইপাস্ট ও দিল্লির রাজপথে বাংলাদেশী কনটিনজেন্টের মার্চ পাস্টের মধ্যে দিয়ে সম্মানিত করা হলো সেই গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকেইÑ এখানে রাজনীতি বা কূটনীতির ছায়া খোঁজার কোনো দরকারই নেই।

 


আরো সংবাদ



premium cement