২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ভারতে বার্ডফ্লু

ভেবেচিন্তে আমদানি বন্ধ করতে চায় সরকার

অতিথি পাখির মাধ্যমেও বিস্তার ঘটতে পারে বার্ডফ্লু; সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
-

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বার্ডফ্লু। বাংলাদেশে এর সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে সীমান্ত দিয়ে হাঁস-মুরগি, ডিমসহ অন্যান্য গৃহপালিত পাখি বা প্রাণী যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য স্বরাষ্ট্র, নৌ পরিবহন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে গত সপ্তাহে চিঠি দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়। ভারত থেকে হাঁস-মুরগি, ডিমসহ অন্য কোনো গৃহপালিত পাখি আমদানি নিষিদ্ধের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছিল; কিন্তু আমদানি নিষিদ্ধে এখনো কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, সীমান্ত সিলগালা করার জন্য তারা অনুরোধ করেছিল কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, ভারতে বার্ডফ্লুর তথ্য আরো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। ভারত থেকে আসলে কী পরিমাণ হাঁস-মুরগির ডিম আসে বা আদৌ আসে কিনা। এতটুকু জানি মুরগি বা ডিম আসে না। একদিনের বাচ্চা আসে। দিল্লিতে আমাদের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর রয়েছেন, তিনিও তথ্য-উপাত্ত নিচ্ছেন। আসলে বর্ডার সিল করার সাথে সাথে তো বাজারে প্রভাব পড়বে। তাই চিন্তাভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ জানান, প্রজ্ঞাপন জারির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এ জন্য অনেক খুটিনাটি দেখে নিতে হয়। কখন কবে হবে তারা বলতে পারবে। তারা নতুন করে এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে সচিব বলেন, হ্যাঁ, তারা কিছু তথ্য জানার জন্য যেমনÑ কী পরিমাণ মুরগি-ডিম আনি, দেশের কোনো সমস্যা হবে কিনা। আসলে কী পরিমাণ ডিম, মুরগি আসে তা জানতে চাইলে এর সঠিক হিসাব নাই। মৎস্য অধিদফতরের কাছে জানতে চেয়েছে। তবে খুব বেশি না।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা: আবদুল জব্বার শিকদার গত বুধবার সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, ১১টি দেশ থেকে হাঁস-মুরগি আমদানি করা হয়। সেই তালিকায় ভারত বা প্রতিবেশী কোনো দেশ নেই। তাদের সাথে কোনো কন্ট্রাক্ট নাই। একদিন বয়সী বাচ্চা, গ্র্যান্ট প্যারেন্টসÑ কোনো কিছুই আসে না ভারত থেকে। ডিম বিদেশ থেকে আসেই না। সতর্ক থাকার জন্যই মূলত তিন মন্ত্রণালয়কে সীমান্ত সিলগালার জন্য চিঠি দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। সাবধানতার জন্যই এটা।
তিনি বলেন, এই রোগ আগেও দেখা দিয়েছিল। এত সচেতনতা তখন দেখা যায়নি। করোনাকালে মানুষ সচেতন। মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফার্ম পরিচালনা করার জন্য খামারিদের আহ্বান জানান তিনি।
সম্প্রতি ভারতের কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল, হরিয়ানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, দিল্লিসহ ১১টি প্রদেশে বার্ডফ্লু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তাই বাংলাদেশেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখে এ রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধ এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র, বাণিজ্য ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে যাতে হাঁস-মুরগি ও পাখিজাতীয় কোনো প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে অনুরোধ জানায় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরকেও নির্দেশ দেয়া হয়।
বাংলাদেশে ২০০৭ সাল এবং পরবর্তী সময়ে বার্ডফ্লু ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পোলট্রি খাত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে। কারণ এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক কোটি মানুষ জড়িত। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ছোট-বড় পোলট্রি খামার আছে প্রায় ৮৮ হাজার। যেখানে গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে সোয়া দুই কোটি ডিম উৎপাদন হচ্ছে এবং মুরগির গোশত উৎপাদন হচ্ছে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার মেট্রিক টন। এটা দেশের নারী ও যুবক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। বিশেষত বাংলাদেশের নি¤œবিত্ত ও নি¤œ-মধ্যবিত্তের আমিষ চাহিদার বেশির ভাগই পূরণ করছে পোলট্রির গোশত ও ডিম। করোনাকালে এমনিতেই এইখাতে খামারিরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন। এরই মধ্যে ভারতে বার্ডফ্লু ছড়িয়ে পড়ার খবরে খামারিদের মধ্যেও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বার্ডফ্লু পাখিদের এক ধরনের জ্বর। এইচ-৫এন ১ ভাইরাসের কারণে এই জ্বর হয়ে থাকে। বন্য, জলচর কিংবা পরিযায়ী পাখির মাধ্যমে খামারের হাঁস-মুরগির মধ্যেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল হক বেগ জানান, করোনা প্রতিরোধের জন্য যা যা আমরা করি এখানেও আসলে তাই করা উচিত। কারণ এটাও একটা ভাইরাস। প্রাণঘাতী ভাইরাস, যা খামার শ্রমিক, খামারের খাদ্য, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি যখন খামারে ঢুকবে তখনই স্প্রে করে জীবাণু মুক্ত করতে হবে। আমাদের অনেক অতিথি পাখি আসে। এই অতিথি পাখির সংস্পর্শে মানুষ, গৃহপালিত পশুপাখি, খামারি, কৃষক অবাধে মিশে যায়। এতে খামারে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আমাদের অতিথি পাখির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। এতে অতিথি পাখিরাও নিরাপদে থাকতে পারবে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কে বি এম সাইফুল ইসলাম বলেন, যারা পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি সংস্পর্শে থাকেন তাদেরও এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাঁচা ডিম কখনোই খাওয়া যাবে না। কাঁচা, হাফ বয়েল বা অর্ধসেদ্ধ গোশত খাওয়া যাবে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন অতিথি পাখিসহ নানা মাধ্যমে বার্ডফ্লু ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে বা খামারে হাঁস-মুরগি আক্রান্ত করতে পারে। তাই শুধু আমদানি বন্ধ করলেই হবে না, বার্ডফ্লু প্রতিরোধে ভ্যাকসিন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থাই নিতে হবে। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) প্রেসিডেন্ট মশিউর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা (বার্ডফ্লু ভাইরাস) আসতে বেশি সময় লাগে না। এটা উড়ে উড়ে চলে আসে। যদি মনে হয় যে রেড অ্যালার্ট জারি করা উচিত, তাহলে তাই করা উচিত; কমপক্ষে আগামী তিন মাসের জন্য। ভ্যাকসিনের পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। ভ্যাকসিন শেষ হলে যাতে দৌড়াদৌড়ি করা না লাগে। মাঝখানে যাতে কোনো গ্যাপ সৃষ্টি না হয়। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) মহাসচিব ডা: মঞ্জুর মোর্শেদ খান নয়া দিগন্তকে বলেন, যারা ভ্যাকসিন নিবে তারা নিরাপদ থাকবে। জীবনিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। খামারে থাকা হাঁস-মুরগিকে ফ্লু থেকে রক্ষায় সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মন্ত্রণালয় ১২ জানুয়ারি প্রাণিসম্পদ অধিদফতরকে চিঠি দেয়। দেশের সীমান্তবর্তী জেলাসহ অন্যান্য জেলায় প্রতিদিন বার্ডফ্লু রোগের অনুসন্ধান এবং সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সরকারি-বেসরকারি খামারে নিবিড় তত্ত্বাবধানের নির্দেশ দেয়া হয়। একই সাথে কোনো মৃত বা সন্দেহজনক হাঁস-মুরগি বা পাখি পাওয়া গেলে নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুত নিকটবর্তী ল্যাব থেকে পরীক্ষা করে ফল অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণেরও নির্দেশনা দেয়া হয় চিঠিতে। জেলা ও উপজেলা ভেটেরিনারি হাসপাতাল ও গবেষণাগারে পর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষার কিট ও পিপিই জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ, খামারে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কৃষক ও খামারিদের সতর্ককরণে ব্যাপক প্রচার চালানো, বার্ডফ্লু প্রতিরোধ কল্পে টিকার বর্তমান মজুদ যাচাই করে দ্রুততার সাথে টিকা সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। একই চিঠিতে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম চালুকরণ এবং সারা দেশ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তা মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিকভাবে জানানোর জন্য বলা হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবু লুৎফে ফজলে রহিম শাহরিয়ার এ বিষয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে জানিয়েছেন, বার্ডফ্লু ট্রান্স বাউন্ডারি ডিজিজ। এটা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং ভারত থেকে বাংলাদেশেও আসতে পারে। বর্ডার সিল করে দেয়া হচ্ছে এটা ভালো খবর। গত কয়েক বছরে ভারত থেকে বাংলাদেশে জীবন্ত পাখি বা ডিম প্রবেশ করে নাই। আনঅফিসিয়ালি করেছে কিনা তা জানি না। সরকারকে অনুরোধ করব যাতে আনঅফিসিয়ালিও বর্ডার দিয়ে কিছু চলে না আসে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে বার্ডফ্লু প্রতিরোধে টিকা কার্যক্রম চলে আসছে। এরপর আর বার্ডফ্লু দেখা দেয়নি। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বার্ডফ্লু প্রটেক্টেড। এজন্য যে আরামে বসে থাকব, সেটা ঠিক হবে না। প্রয়োজনীয় কার্যক্রম ও প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
শাহরিয়ার বলেন, খামারি বা মানুষের মধ্যে যতটা সম্ভব সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। দেশে ছোট-বড় অনেক খামার আছে যারা ব্রিডিং করে। আনরেজিস্ট্রার্ড সমস্ত ব্রিডিং ফার্ম গড়ে তোলা বন্ধ করতে হবে। সবাইকে আইনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ভ্যাকসিন দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। যত্রতত্র ফার্ম গড়ে তেলো বন্ধ করতে হবে। বায়ো সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement