২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মৃত্যুদণ্ডেও বন্ধ হচ্ছে না ধর্ষণ

১৬২৭ জন নারী ও শিশু শিকার ২০২০ সালে; হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে
-

প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের মতো পৈশাচিক ও জঘন্য ঘটনা ঘটছে। নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কোমলমতি ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা কিংবা প্রতিবন্ধী নারী কেউই। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দিলেই ছাত্রীদের তুলে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হচ্ছে। আবার কুপ্রস্তাবে সম্মতি না দিলেই কখনো কখনো রাতে ঘরে ঢুকে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ধর্ষণ করার পর মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে ছেড়ে দিচ্ছে নরপিশাচরা। কেউ কেউ লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। গত বছরের অক্টোবরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করা হয়। ২০০০ সালের এই আইনের ৯ (১) ধারায় এতদিন সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তারপরও যেন থামছে না ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণের ঘটনা। নতুন বছরের এ ক’দিনে অন্তত ১০০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কয়েকজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে মাস্টার মাইন্ড স্কুলের এক ছাত্রীকে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করে লম্পট তানভীর ইফতেখার দিহান। বছরের শুরুতেই ধর্ষণের পর হত্যার এ পৈশাচিক ঘটনাটি মানুষের মনে অনেক দাগ কেটেছে। অবশ্য দিহানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগে বছরের প্রথম দিন রাতে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় এক গৃহবধূর ঘরে ঢুকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে তার সন্তানদের সামনেই বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে স্থানীয় সন্ত্রাসী জিয়া ওরফে জিহাদ, এনায়েত, ভুট্টু মাঝি ও ফারুক। ওই সন্ত্রাসীরা তাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালানোর দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গত বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বামীর সাথে বেড়াতে গিয়ে নববিবাহিত এক তরুণী সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগ কর্মীদের দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনায় সারা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ওই ঘটনার বিচার শুরু হয়েছে। নোয়াখালী ও সিলেটের ঘটনা দু’টি রাজধানীসহ সারা দেশে সমালোচনার ঝড় তুলে। এ নিয়ে দেশব্যাপী বিক্ষোভ হয়েছে।
গত ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মিরপুর-১ গোলচত্বর এলাকায় ফুল বিক্রেতা এক কিশোরী (১২) ধর্ষণের শিকার হয়। ফুল বিক্রি করেই জীবন চলত ওই ভাসমান কিশোরীর। এরপরে গত ১৬ জানুয়ারি সাভারের রাজাসন মণ্ডলপাড়া এলাকায় ৯ বছরের এক শিশু ভাড়া বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়। একই দিনে নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পশ্চিমপাড়া এলাকায় প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক নারীকে ধর্ষণ করে অটোরিকশাচালক রনি। এর আগে গত ১৪ জানুয়ারি জামালপুরের বকশীগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন এক নারী পোশাক শ্রমিক। একই দিনে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার হাসপাতাল রোড থেকে এক স্কুলছাত্রীকে জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে ভিডিও ধারণ করে এক লম্পট। ওই ঘটনায় অপহরণের পর ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণের অভিযোগে থানায় মামলা হয়েছে। এ রকম দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কোনোটার খবর প্রকাশ পাচ্ছে, আবার কোনোটার খবর গণমাধ্যম এড়িয়ে যাচ্ছে। ধর্ষণের ভিডিও ভাইরাল হলেই কেবল তোলপাড় সৃষ্টি হয়, মামলা হয়, বিচার হয়। অনেক ঘটনা সময়ের ব্যবধানে আড়ালে গিয়ে ফাইলবন্দী হয়ে থাকে।
আইন ও সালিস কেন্দ্র-আসকের ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এক হাজার ৬২৭ জন নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে এবং ১৪ জনকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৩২৬ জনকে। ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয় এক হাজার ৪১৩ নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৭৬ জনকে এবং ১০ জন নারীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়। ২০১৮ সালে এ সংখ্যাটি ছিল ৭৩২। ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের তুলনায় গত বছর ধর্ষণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ৮৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে শিশু ধর্ষণ ৭৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেড়েছে। তবে প্রকৃত পরিসংখ্যান এর থেকে কয়েকগুণ বেশি বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে অবাধ যৌন স্বাধীনতার একটা চর্চা রয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের ভেতরে কোনো নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে উঠেনি। ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি। নাস্তিক্য মতবাদ ও পশ্চিমা সংস্কৃতি সমাজকে গ্রাস করছে। তা ছাড়া দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তো আছেই। আবার আইনের ফাঁক গলিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এসব কারণেই ধর্ষণের মত ঘৃণ্য অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আগে ধর্ষণকে একটি সামাজিক অপরাধ হিসেবে দেখা হতো; যার কারণে সমাজের কেউ এ ধরনের অপরাধ করলে এলাকার মাতব্বর, মেম্বার-চেয়ারম্যান ও আলেম-ওলামা সমন্বয়ে সালিসি বৈঠকের মাধ্যমে বিচার করা হতো। এখন সেই বিচার আর হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো: নুরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, বেশির ভাগ ধর্ষণ হচ্ছে ফ্রি স্টাইলে চলাফেরা করার কারণে। আধুনিকতার নামে উচ্ছৃখলভাবে চলাফেরার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। দেখেন কিছু দিন আগে কলাবাগানে এক স্কুলছাত্রীকে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই যে, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা এখান থেকেই মূলত ভালোলাগা শুরু হয়। এরপর একপর্যায়ে সর্বনাশ ডেকে আনে। আমাদের দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রীতিনীতি শিক্ষা এবং মেনে চলায় বড় ধরনের ঘাটতি আছে। নৈতিক শিক্ষা নেই। তিনি বলেন, আইন আছে কিন্তু কেউ তোয়াক্কা করছে না। যেমনÑ দুদক আছে দুর্নীতি কি কমছে? লুটপাটের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে, বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। মোটকথা সব কিছুর একটা ভারসাম্য থাকতে হয়। আমাদের দেশে ভারসাম্যহীন রাজনীতি চলছে। যারা এসব অপরাধ করছে তাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের অথবা তাদের ছত্রছায়ায় থাকে। ফলে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। অনেক ঘটনার বিচারও হয় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, সমাজ ও রাষ্ট্রে ভারসাম্য না থাকায় অপরাধগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement