২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
গবেষণার তথ্য

ঢাকা দক্ষিণের ৭৫ ওয়ার্ডের ৭৪টিতেই দরিদ্রদের বসবাস

-

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মোট ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭৪ ওয়ার্ডেই দরিদ্র মানুষ বসবাস করেন। এসব ওয়ার্ডে মোট দরিদ্র এলাকা রয়েছে ৭৮৬টি। যেখানে মোট ৭১ হাজার ৩৪৬টি পরিবারের তিন লাখ ৪২ হাজার ৪০৯ দরিদ্র মানুষ বসবাস করেন। জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে করা এক গবেষণায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ গবেষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে নগরে দারিদ্র্য কমানোর উপায় খোঁজা। থাকার জায়গা, সুপেয় পানি, পরিবারের আয়, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শৌচাগারের ব্যবস্থা, জমি ভোগ-দখলের নিরাপত্তা, উচ্ছেদের ঝুঁকি, বর্র্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ সংযোগ, সড়ক ও ড্রেনের (নালা) সুবিধাসহ ১৯ ধরনের নাগরিক সুবিধাকে বিবেচনায় নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডের ওপর এ গবেষণা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে কাজটি করেছে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট (ডিএম) ওয়াচ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে গবেষণায় সিটির দরিদ্র মানুষের সঠিক চিত্র উঠে আসেনি বলে অভিযোগ করেছেন মেয়র ও কাউন্সিলররা।
গবেষণা থেকে জানা যায়, ডিএসসিসির মোট ৪ দশমিক ৫ ভাগ এলাকায় দরিদ্র মানুষ বসবাস করে। এর মধ্যে ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড তথা জুরাইন এলাকায় সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষের বসবাস। এ ওয়ার্ডের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ এলাকাতেই গরিব মানুষ রয়েছে। এরপর ৫৮ ও ৭১ নম্বর ওয়ার্ডের ২০ ভাগ এলাকায় এবং ৫৪, ৬০ ও ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের ১৫ ভাগ এলাকায় গরিব মানুষ বসবাস করে। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৫টি, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৪১টি, ৫১ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৮টি এবং ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৪২টি দরিদ্র এলাকা রয়েছে। তবে ১০ নম্বর ওয়ার্ড তথা মতিঝিল কলোনি এলাকায় কোনো দরিদ্র লোক নেই। গত মঙ্গলবার ঢাকা দক্ষিণের নগর ভবনে এ গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। এ সময় গবেষক দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কমপক্ষে পাঁচটি বাড়ি রয়েছে এমন এলাকাকে একটি বসতি ধরা হয়েছে। যে এলাকায় এর কম দরিদ্র পরিবার আছে সে এলাকা গবেষণায় আসেনি। আবার অনেক ধনী এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে দরিদ্র পরিবার বসবাস করলেও তা গবেষণায় আসেনি। এ কারণে গবেষণায় আসা দরিদ্র লোকের চেয়ে দক্ষিণ ঢাকায় আরো বেশি দরিদ্র লোক রয়েছে।
নগর ভবনে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনকালে এর সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কয়েকজন কাউন্সিলর। তাদের সাথে যোগাযোগ না করেই গবেষণার ফলাফল তৈরি করা হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে তারা হইচই করলে অনুষ্ঠানটি পণ্ড হয়ে যায়। অনুষ্ঠানে দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসও উপস্থিত ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেও এ গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। মেয়র বলেন, এ গবেষণায় দক্ষিণ সিটির দারিদ্র্যের চিত্র সঠিকভাবে উঠে আসেনি। অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, একটি ওয়ার্ডের কোথায় অনুন্নত বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করলে পরবর্তী সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ঠিকভাবে করা যাবে না। এ গবেষণায় দারিদ্র্য নিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টি আরো পরিষ্কার হওয়া দরকার। তবে সবচেয়ে দরিদ্র থাকা ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মীর হোসেন মীরু নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের ওয়ার্ডের বস্তিগুলোর চিত্র ম্যাপে দেখানো হয়েছে। সে ম্যাপে আমার স্বাক্ষর নিয়েছে গবেষক টিমের সদস্যরা।
অনুষ্ঠানে গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন ডিএম ওয়াচের গবেষণা দলের প্রধান বায়েজীদ হাসান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, গবেষণার সময় আমাদের টিম বারবার স্থানীয় কাউন্সিলরদের সাথে কর্মশালা করেছেন। কাউন্সিলরদের মনোনীত প্রতিনিধিরাও মাঠপর্যায়ের কাজে যুক্ত ছিলেন। মাঠপর্যায়ের সর্বশেষ মানচিত্রে তারা স্বাক্ষরও করেছেন; কিন্তু এখন তারা কী কারণে বিরোধিতা করছেন তা আমরা বুঝতে পারছি না। হয়তো তাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তবে এ জরিপ ঠিক আছে। এ ফলাফলই আমরা ইউএনডিপিকে সরবরাহ করব। তিনি আরো বলেন, পুরো ওয়ার্ডের সামগ্রিক চিত্র নয়, বরং প্রতিটি ওয়ার্ডে দরিদ্র মানুষের অবস্থানের মানচিত্র তৈরি করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এ গবেষণা পরবর্তী সময়ে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদেরই কাজে লাগবে। তাদের এলাকার দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণে এ গবেষণা সহায়তা করবে।
গবেষণা দলের আরেক টিম লিডার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. গোলাম মঈনুদ্দিন জানান, ডিএসসিসির ওয়ার্ডভিত্তিক দরিদ্র বসতি শনাক্ত করতে গিয়ে স্থানীয় কাউন্সিলরদের দেয়া ছয়জন করে প্রতিনিধি আমাদের সাথে কাজ করেছেন। সর্বশেষ তৈরি ম্যাপে কাউন্সিলরদের স্বাক্ষর রয়েছে। ফলে এ গবেষণা ও ফলাফল সম্পর্কে তারা আগে থেকেই জানেন।
গবেষণায় বলা হয়, দক্ষিণ সিটির মোট ১০টি ওয়ার্ডে (১, ৭, ১৫, ১৬, ৩২, ৩৩, ৪০, ৫০, ৫৫ ও ৭৫) দরিদ্র মানুষের বসবাসের এলাকায় যথাযথ পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। এসব ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতাও বেশি হয়। দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতে ৭৫ শতাংশের বেশি দরিদ্র পরিবারের মাসিক গড় আয় সাড়ে আট হাজার টাকার কম। ১, ৭ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের দরিদ্র বসতির অর্ধেক মানুষ কর্মহীন। ১৫টি ওয়ার্ডে (৭, ১২, ১৯, ২০, ৩৩, ৩৯, ৪৬, ৫০, ৫৩, ৫৪, ৬৮, ৭০, ৭১, ৭২ ও ৭৪ ) আর্থ-সামাজিক অবস্থা নাজুক। ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের দরিদ্র বসতির ৫০ ভাগ মানুষ নানাবিধ সামাজিক সমস্যার শিকার। নয়টি ওয়ার্ডের (৩, ৫, ৬, ১৯, ২০, ২১, ৩৯, ৪০, ৭১ এবং ৭৩ নম্বর) বেশির ভাগ দরিদ্র বসতিতে প্রায় সব বাড়িই অস্থায়ী। ১৯টি ওয়ার্ডের ( ১, ২, ৫, ৬, ১১, ১২, ১৫, ১৬, ২২, ২৪, ৩৭, ৪০, ৪৩, ৪৮, ৫৬, ৫৭, ৭১, ৭২ ও ৭৩) দরিদ্র বসতিতে কমপক্ষে ৭৫ ভাগ পরিবার অন্যের জমিতে বসবাস করে। এ ছাড়া নয়টি ওয়ার্ডের (৭, ১৫, ২০, ২১, ৩৮, ৫৫, ৫৭, ৬৭ ও ৭০) দরিদ্র এলাকায় ৭৫ ভাগ পরিবার ওয়াসার সাপ্লাই পানি পায় না।


আরো সংবাদ



premium cement