২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাঘাবাড়ীমুখী যমুনার ৩২টি পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট

উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল সঙ্কটের আশঙ্কা; আটকা পড়েছে ৫০টি জাহাজ
-

বাঘাবাড়ী বন্দরের ভাটি যমুনা নদীর প্রায় ৩২টি পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বেড়ার নাকালিয়ায় এক কোটি ৬১ লাখ লিটার জ্বালানি তেলবাহী ২৩টি জাহাজসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পণ্যবাহী ৫০টি জাহাজ ডুবোচরে আটকা পড়েছে। আটকে পড়া জাহাজের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। নাব্যতা সঙ্কটে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজ অর্ধেকেও কম লোড নিয়ে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে আসতে পারছে না। মাঝ নদীতে আটকে পড়া জাহাজ থেকে লাইটারেজ করে পণ্যসামগ্রী বাঘাবাড়ী বন্দরে আনা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ সময়মতো ড্রেজিং না করায় নাব্যতা সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করছে তেল ডিপো সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।
গত শনিবার দুপুরে বেড়া নাকালিয়া সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও মংলা বন্দর থেকে বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে ছেড়ে আসা এম ভি জুয়েল, এম ভি ফেয়ারি-৫, ওটি আছিয়া বেগম, এম ভি সুমাইয়া হোসেন, এম ভি ফয়সাল-৪, এম ভি ফয়সাল-৬, এম ভি ফয়সাল-৮, এম ভি ইব্রাহীম খলিল-১, জুয়েল-১, আল তায়েফ, এম ভি আফিফা, এম ভি ওয়ারিশ আহনাফ, সততা পরিবহন, মাজননী, বিসমিল্লাহ, আছিয়া পরিবহন, ভাই ভাই, আবু ছালে, এম ভি জুয়েল, এম ভি আছিয়া, এম ভি সুমাইয়া, মেসার্স করিম শিপিং লাইন্স-২, ওটি শিপার্স ওয়ানন্ড-২, ওটি করিম-৬, এম ভি সুলতানসহ ৫০টি জাহাজ নাকালিয়াসহ আরিচা পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে যমুনার ডুবোচরে আটকা পড়েছে। কার্গোজাহাজগুলো জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সার, কয়লা ও গম নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে যাচ্ছিল। এর আগে গত ২ জানুয়ারি ১২টি জাহাজ জ্বালানি তেল নিয়ে পেঁচাকোলায় ডুবোচরে আটকা পড়েছিল। এ দিকে পেঁচাকোলার উজানে প্রায় ১৫-১৬টি ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় ভাটিতে ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে।
বাঘাবাড়ী বন্দরের সহকারী পরিচালক এস এম সাজ্জাদুর রহমান জানান, দৌলতদিয়া-বাঘাবাড়ী নৌপথে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মাধ্যম। এ নৌপথে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গোজাহাজ চলাচল করে। বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে উত্তরাঞ্চলে চাহিদার ৯০ ভাগ জ্বালানি তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ করা হয়। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে বাঘাবাড়ী বন্দরের মাধ্যমে চাল ও গমসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। নাব্যতা সঙ্কটে বন্দরে আমদানি রফতানি প্রায় ৭০ ভাগ কমে গেছে। এ নৌ-চ্যানেলের নাকালিয়া পয়েন্টে প্রচণ্ড নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ নৌ- চ্যানেলের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তবে বিআইডব্লিউটিএর একটি সূত্র বাঘাবাড়ী বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ করে বলেছেন, তারা সঠিক সময়ে তথ্য না দেয়ায় সময়মতো ড্রেজিং করা সম্ভব হয় না, যখন জাহাজ আটকা পড়ে তখনি আমাদের জানানো হয়।
বিপিসির বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপো ও বিসিআইসির বাফারগুদাম সূত্রে জানা যায়, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুরÑ এই ১৯ জেলায় জ্বালানি তেল চাহিদার ৯০ ভাগ বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপো থেকে জোগান দেয়া হয়। প্রায় ৩০ লাখ লিটার জ্বালানি তেল ভর্তি পাঁচটি জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরের আনলোডের অপেক্ষায় রয়েছে। সেচ মওসুমে এখান থেকে প্রতিদিন ৪০ লাখ লিটার জ্বালানি তেল ও হাজার হাজার বস্তা রাসায়নিক সার সরবরাহ করা হয়। নাব্যতা সঙ্কট দ্রুত নিরসন না হলে এ অঞ্চলে সেচ ও সার নির্ভর বোরো আবাদ ব্যাহত হতে পারে বলে কৃষি বিভাগ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী বিভাগীয় এক কর্মকর্তা বলেন, উত্তরাঞ্চলে প্রায় পাঁচ শতাধিক পেট্রলপাম্প, তিন শতাধিক ডিলার এবং পাঁচটি ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। নাব্যতা সঙ্কটে আন্ডারলোড নিয়ে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে ভিড়ছে। তিনটি কোম্পানিতে প্রতিদিন রিসিভ হচ্ছে মাত্র ১৬ লাখ লিটার জ্বালানি তেল। সেচ মওসুমে বাঘাবাড়ীর ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এই তিনটি কোম্পানি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩৬ লাখ লিটার জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এই চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ লাখ লিটারে। প্রতিদিনের ঘাটতি প্রায় ২০ লাখ লিটার পূরণ করা হচ্ছে আপৎকালীন মজুদ থেকে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি সঙ্কট দেখা দেবে। এতে সেচনির্ভর বোরো আবাদে এবং বিদু্যুৎ উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
রাজশাহী ও রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বোরো মওসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় সেচের জন্য সাত লাখ ৯৬ হাজার ৭৫টি সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ডিজেল ও ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎনির্ভর। সেচ মওসুমে ডিজেলচালিত ৮২৮টি গভীর নলকূপ, পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার ৮৭০টি অগভীর নলকূপ, ১১ হাজার ৩৭৭টি শক্তিচালিত পাম্পের সাহায্যে সেচকার্যক্রম চলবে। এর জন্য প্রায় ৬০ কোটি লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হবে। ডিজেল চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগ বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপো থেকে সরবরাহ করা হয়। জ্বালানি তেলনির্ভর বেড়ার ৭১ মেগাওয়াট, বাঘাবাড়ীর ৫০ মেগাওয়াট, রাজশাহীর আমনুরা ৫০ মেগাওয়াটসহ পাঁচটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। বিদ্যুৎচালিত সেচপাম্পের রয়েছে দুই লাখ ১০ হাজার। সেচের জন্য বাড়তি বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে প্রায় ৮৪৩ মেগাওয়াট। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার না গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। সেই সাথে এ অঞ্চলের সেচনির্ভর বোরো আবাদের ভরা মওসুমে আবাদ ও উৎপাদনে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাত এই নৌপথ নিয়ে সরকারকে ¯œায়ুচাপে থাকতে হয়।
বিসিআইসির বাঘাবাড়ী ট্রানজিট বাফার গুদাম সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের ১৪টি বাফার গুদামে রাসায়নিক সার চাহিদার ৯০ ভাগ বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে জোগান দেয়া হয়। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার বস্তা রাসায়নিক সার সড়কপথে বাফার গুদামগুলোতে সরবরাহ করা হয়। যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কটে বাফার গুদামগুলোতে আপৎকালীন সারের মজুদ গড়ে তোলার কাজ চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে। বিসিআইসির বগুড়া আঞ্চলিক অফিস সূত্রে জানা যায়, ইরিবোরো আবাদ মওসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ১২ লাখ টন রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় সারের বেশির ভাগই বাঘাবাড়ী বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয় পরে সেখান থেকে সড়কপথে বাফারগুদামে পাঠানো হয়। বাফারগুদামগুলোতে আপৎকালীন মজুদ আছে দুই লাখ ৮০ হাজার টন। যমুনা নৌরুটে নাব্যতা সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় আপৎকালীন সার মজুদের কাজ কিছুটা বিঘিœত হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অফিসের একটি সূত্রে জানা যায়, রাসায়নিক সার ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য ১০ থেকে ১১ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন হয়। বর্তমানে আরিচা থেকে নগরবাড়ী পর্যন্ত যমুনা নদীতে ২০ থেকে ২৫টি ডুবোচর ও প্রচণ্ড নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও পানির স্তর কমে ছয় থেকে সাত ফুট দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া এই নৌপথের মোহনগঞ্জ, হরিরামপুর, চরসাফুল্লা, নাকালিয়া, পেঁচাকোলায় প্রচণ্ড নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে নাকালিয়া পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে মোহগঞ্জ, হরিরামপুর পয়েন্টে ডুবোচরে জ্বালানি তেল ও পণ্যবাহী জাহাজ মাঝে মধ্যেই আটকা পড়েছে। দ্রুত নাব্যতা সঙ্কট নিরসনে চারটি ড্রেজার কাজ করে যাচ্ছে বলে বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অফিস সূত্রে জানা গেছে।
এম ভি চিলিং বিজয় এর মাস্টার হেলাল উদ্দিন জানান, দৌলতদিয়া থেকে বাঘাবাড়ী নৌবন্দর পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার নৌপথের ৩২টি পয়েন্টে পানির গভীরতা কমে দাঁড়িয়েছে ছয় থেকে সাত ফুট। সরু হয়ে গেছে নৌ-চ্যানেল। মোহনগঞ্জ ও নাকালিয়া পয়েন্টে কার্গোজাহাজ চলাচলের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এ পয়েন্টে দু’টি জাহাজ পাশাপাশি চলাচল করতে পারছে না। ওই পয়েন্টে জেগে ওঠা চরের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় দিনদিন চ্যানেলটি আরো সরু হয়ে যাচ্ছে। এই পয়েন্টে দ্রুত ড্রেজিং না করা হলে পণ্যবাহী ও জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিপিসির বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপোর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, বাঘাবাড়ীতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি তেল কোম্পানির ডিপোর আপৎকালীন মজুদ থেকে জ্বালানিীতেল সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রায় ৩০ লাখ লিটার জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ বন্দরে আনলোডের অপেক্ষায় রয়েছে। নাকালিয়াতে এক কোটি ৬১ লাখ লিটার জ্বালানি তেলবাহী ২৩টি জাহাজ যমুনা নদীতে আটকা পড়েছে। নাব্যতা সঙ্কটে জাহাজগুলো বন্দরে আসতে পারছে না। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল সঙ্কটের আশঙ্কা নেই। তবে এ অবস্থা চলমান থাকলে জ্বালানি তেলের সঙ্কটের আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement