২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
বিদেশে বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনাদের তথ্য চেয়েছে দুদক

মালয়েশিয়া আমার দ্বিতীয় বাড়িতে তৃতীয় বাংলাদেশীরা

-

‘মালয়েশিয়া আমার দ্বিতীয় বাড়ি’Ñ দেশটির সরকারের নেয়া দীর্ঘমেয়াদি আবাসন কর্মসূচিতে এখন পর্যন্ত তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশীরা। প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন এবং জাপান। চার হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির মধ্যে কামরুল হুদা নামে একজন বাংলাদেশীর কুয়ালালামপুরে সেকেন্ড হোম প্রকল্পে নাম লেখানোর খোঁজ পাওয়া গেছে। তিনি গুলশানের বাসিন্দা। ব্যবহার করেন একাধিক দামি গাড়ি। নামে-বেনামে তার অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের লিখিত অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) রয়েছে। গোপনে বিষয়টি অনুসন্ধান চলছে বলেও জানা গেছে। শুধু কামরুল হুদা নন, তার মতো যারাই মালয়েশিয়া ‘মাই সেকেন্ড হোম কর্মসূচি’তে নাম লিখিয়েছেন, তাদের সবার ব্যাপারেই উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা আসার পর দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছে।
কুয়ালালামপুর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০০২ সালে এই কর্মসূচি চালুর পর থেকে মোট চার হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিক “মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম” (এমএম২এইচ) সুবিধা গ্রহণ করেছেন। করোনার কারণে মালয়েশিয়ায় গত বছর সেকেন্ড হোমের কার্যক্রম চলেছে কি না তা জানা সম্ভব হয়নি। এমএম২এইচ কর্মসূচিটি সামাজিক ভিজিট পাস সরবরাহ করে; যা সুবিধাভোগীদের মালয়েশিয়ায় ১০ বছর থাকার সুযোগ দেয়।
পর্যটন শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০০২ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১৩০টিরও বেশি দেশের প্রায় ৪০ হাজার নাগরিক এই সুবিধা পেয়েছেন। চীনা নাগরিকরা ১১ হাজার ৮২০টি অনুমোদিত এপ্লিকেশন নিয়ে শীর্ষে রয়েছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে ৮ হাজার ৬১৮ জন জাপানি এবং চার হাজার ১৮ জন বাংলাদেশী বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে আছেন। এরপরের অবস্থানে রয়েছেÑ যুক্তরাজ্যে, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইরান, তাইওয়ান, পাকিস্তান ও ভারত।
বাংলাদেশীরা বর্তমানে এমএম২এইচ উপকারভোগীদের ১০ শতাংশ ভাগ করে নিয়েছেন। ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ৮৫২ জন বাংলাদেশী এই সুবিধা গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচির আওতায় মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় বাড়ি কেনার জন্য ৫০ বছরের কম বয়সী যেকোনো বাংলাদেশি তার ন্যূনতম ০.০৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ইনকাম ০.০২ মিলিয়ন ডলার অফশোর উপার্জনসহ তারল্য সম্পদের প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে প্রতি মাসে কমপক্ষে দুই হাজার ৪৫০ মার্কিন ডলার। আবার ৫০ বছর বা তার বেশী বয়সের আবেদনকারীর জন্য একটু শিথিলতা রয়েছে। তাকে প্রতি মাসে ১০ হাজার এমএম অফশোর উপার্জনের পাশাপাশি আরএম ০.৩৫ মিলিয়ন প্রমাণ দেখাতে হবে। সুতরাং মালয়েশিয়ায় ১০ বছরের রেসিডেন্সির অনুমতি পেতে একজন বাংলাদেশী নাগরিককে কমপক্ষে ৭.২০ মিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগকারী দ্বিতীয় দেশে অর্থ বিনিয়োগের কোনো আইনগত সুযোগ না থাকায় এমএম২এইচ ব্যবহার করা বাংলাদেশীরা দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ জোগাড় করেছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে এ তথ্যগুলো উল্লেখ রয়েছে বলে একাধিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে তা প্রকাশ করেছে। তবে এমএম২এইচ প্রকল্পে কোন কোন পেশার কতজন বাংলাদেশী নাম লিখিয়েছেন সেই তথ্য মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরের মতো প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করেছে বলে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে। তবে এই প্রকল্পে বাংলাদেশী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলার সংখ্যাই বেশি রয়েছে বলে গুঞ্জন আছে। এ ছাড়া যারা টুরিস্ট ভিসায় অবৈধভাবে এক সময় দেশ থেকে কাজ করার উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন, এমন অনেক বাংলাদেশীর নামও রয়েছে এই তালিকায়। যারা ইতোমধ্যে স্থানীয় মালয় মেয়ে বিয়ে করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের বড় বড় কনডোমোনিয়ামে বাংলাদেশীরা মালয়েশিয়া আমার দ্বিতীয় বাড়ি কিনে চোখ ধাঁধানো ডেকোরেশন করেছেন। অবসর পেলেই মাঝেমধ্যে তারা তাদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে সেখানে রিলাক্সমুডে সময় কাটাতে যান।
মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমের মালিক কামরুল হুদা একজন ব্যবসায়ী। তিনি ট্রাভেল ব্যবসার সাথে জড়িত। কুয়ালালামপুরে একটি কনডোমোনিয়ামে তার প্রায় দুই হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট রয়েছে। সেখানেই বিভিন্ন ফ্লোরে একাধিক বাংলাদেশীর রেডি ফ্ল্যাট কেনা আছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার একজন ব্যবসায়ীর নামও আছে।
শুধু কামরুল হুদা বা পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীই নন, হাজার হাজার বাংলাদেশী গোপনে দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করে মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে নাম লিখিয়ে আরাম-আয়েশে এখন দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে আবার আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকছেন। কিন্তু তারা নিজেদের নামে সেকেন্ড হোম ক্রয়ের কথা আত্মীয়স্বজনসহ কাউকেই বলতে পারছেন না। একই চিত্র বিরাজ করছে কানাডার বেগমপাড়া, যুক্তরাজ্যে ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান অনেক আগেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, বিদেশে অর্থ ছাড়তে দ্বিতীয় হোম স্কিম একটি বড় চ্যানেল হয়ে দাড়িয়েছে। ‘লোকেরা এই প্রকল্পে নাম লেখানোর জন্য কেবল ফি প্রদান করছে না। বাড়িঘর, অন্যান্য সম্পত্তি এমনকি ব্যবসায়ের জন্যও অর্থ পাচার করছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয়ই জাতিসঙ্ঘের দুর্নীতি দমন কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। সুতরাং, বাংলাদেশ সহজেই এই বিষয়ে তথ্য চাইতে পারে।
প্রসঙ্গত, যারা দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি/ফ্ল্যাট কিনেছেন কেবল তাদেরই তথ্য চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত শুক্রবার দুদক থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ‘বিদেশে যারা বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বা বাড়ি ক্রয় করেছে, তাদের তথ্য চেয়েছে দুদক’। প্রকৃত পক্ষে বিষয়টি এমন নয়; দুদক মূলত মহামান্য আদালতের নির্দেশে এ দেশের অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে-আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে অর্থ পাচারের মাধ্যমে যারা বিদেশে (কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে) বাড়ি/ফ্ল্যাট ক্রয় করেছে, এমন বাংলাদেশী নাগরিকদের বিষয়ে তথ্য চেয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে এক পত্রের মাধ্যমে এ অনুরোধ জানানো হয় বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement