১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
গবেষণার ফলাফল প্রকাশ

তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে এখনো ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

-

বাংলাদেশে আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়নের কিছুটা অগ্রগতি হলেও তা সন্তোষজনক নয়। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৬৮ অর্থাৎ এখনো দেশ তামাক কোম্পানির শক্তিশালী হস্তক্ষেপ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে এক গবেষণায় বলা হয়েছে। গবেষণায় বেরিয়েছে, দুইটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানি করোনাকালীন লকডাউনের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সিগারেট উৎপাদন, বিপণন, সরবরাহ এবং তামাকপাতা ক্রয়সংক্রান্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিশেষ অনুমতি আদায় করে নেয়। সুশীলসমাজ বলছেন, মুহামারীর মধ্যে অনেক তামাক কোম্পানিকে প্রণোদনার টাকা দেয়া হয়েছে, এটা হতে পারে না। মূলত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কর্মসূচির অজুহাতে তারা নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনের সাথে মিশে নানাবিধ ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে।
ঢাকায় প্রকাশিত ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক : এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ২০২০’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অনলাইনভিত্তিক জুম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গতকাল গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের প্রাক্তন সমন্বয়ক মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস।
এ ছাড়া ওয়েবিনারে আলোচনায় অংশ নেন, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস বাংলাদেশের কান্ট্রি অ্যাডভাইজার মো: শফিকুল ইসলাম, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার ডা: সৈয়দ মাহফুজুল হক, দ্য ইউনিয়নের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার সৈয়দ মাহবুবুল আলম, গ্রান্টস ম্যানেজার, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে) এম এ সালাম এবং নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা, এ বি এম জুবায়ের, এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স-আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন। সঞ্চালনায় ছিলেন এটিএন বাংলার বার্তা সম্পাদক ও আত্মার কো-কনভেনর নাদিরা কিরণ। গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কর্মসূচি প্রধান মো: হাসান শাহরিয়ার।
গবেষণার সুপারিশে আইন সংশোধন করে তামাক কোম্পানির সর্ব প্রকার সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে আর্টিক্যাল ৫.৩ প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সচেতন করতে সুপারিশ করা হয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল না থাকায় তামাক কোম্পানিগুলো খুব সহজেই এসব মন্ত্রণালয়কে বিভ্রান্ত করতে পারে। এ ছাড়াও তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ মোকাবেলায় একটি সহজ তামাক কর ও মূল্যনীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার/বিনিয়োগ প্রত্যাহার, তামাক কোম্পানি এবং এর প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগের সব তথ্য এবং নথি প্রকাশ, তামাক কোম্পানির সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ এর আলোকে আচরণবিধি চূড়ান্তকরণ এবং তামাক ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, তামাক অপরিহার্য পণ্য তবে শুধু মৃত্যুর জন্য, জীবনের জন্য নয়। এটি কোনোভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় থাকতে পারে না। তিনি বলেন, আমি ইতোমধ্যেই তামাকপণ্যকে এই তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য জাতীয় সংসদে বেসরকারি সদস্য বিল জমা দিয়েছি।
মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, সরকার সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আশা করব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজ মন্ত্রণালয় ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রণালয় বিশেষ করে অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালকে আর্টিক্যাল ৫.৩ প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সচেতন করবে।
ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কোভিড-১৯ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে তামাক ব্যবহার কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। এটা এমন একটা সমস্যা যার সমাধানে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয় বরং সব মন্ত্রণালয় মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
এ দিকে গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক কোম্পানিগুলো সিএসআর কর্মসূচির অজুহাতে নীতিনির্ধারক, সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রশাসন যন্ত্রের সাথে মিশে ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় এবং তামাকনিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদানের চেষ্টা করেছে। একই সাথে এসব সিএসআর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রচার করে জনমনে নিজেদের সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির চেষ্টা করেছে কোম্পানিগুলো। ২৫ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর হাতে অনুদানের চেক হস্তান্তর করে এবং এ সংক্রান্ত সংবাদ ও ছবি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ফেসবুক পেইজে প্রচার করা হয়। কোম্পানিগুলো এনবিআরকে ব্যবহার করে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণনীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদানের চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণনীতি, ২০১৯ চূড়ান্তকরণে তামাক কোম্পানির মতামত গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি প্রদান করেছে।
উল্লেখ্য, সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ এর আলোকে একটি নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে প্রজ্ঞা এই গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করে আসছে। এ বছর বিশে^র ৫৭টি দেশে এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। তামাক কো¤পানির হস্তক্ষেপের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশি। ২০২০ হস্তক্ষেপ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৬৮, যা গত বছর ছিল ৭৭। সূচকে স্কোর যত বেশি, হস্তক্ষেপ তত বেশি। ব্লুমবার্গ ফিল্যানথ্রপিসের স্টপ (স্টপিং টোব্যাকো অরগানাইজেশন্স অ্যান্ড প্রোডাক্টস) প্রজেক্টের আওতায় এই গবেষণায় সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছে গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি), থামাসাত ইউনিভার্সিটি থাইল্যান্ড।

 


আরো সংবাদ



premium cement