২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রোগী ভাগিয়ে ক্লিনিকে নিলেই কমিশন

দালালদের দৌরাত্ম্য থামছে না পঙ্গু হাসপাতালে; জড়িত চিকিৎসক, কর্মকর্তা কর্মচারী
-

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের আবুল কালাম। গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙেছে তার। ভাই আবুল কাশেমের সাথে গতকাল গ্রামের বাড়ি থেকে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল)। ডাক্তার দেখানোর জন্য যথারীতি বহির্বিভাগের কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভাইয়ের সাথে। দাঁড়ানোর একটু পরেই বাধে বিপত্তি। দুইজন লোক এসেই আবুল কাশেমের হাত থেকে টিকিটটি নিয়ে বলেন, চলেন বাইরের ক্লিনিক থেকে একটি এক্সরে করে আনতে হবে। এতে বাদ সাধে দুই ভাই। তাদের সাথে বাগি¦ত া হয় দালালদের। একপর্যায়ে অনেকটা টেনেহিঁচড়ে বহির্বিভাগ থেকে তাদের বাইরে নিয়ে আসে দালালরা। শুধু আবুল কাশেমই নয়, এরকম অসংখ্য রোগীকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতে হয়, হয়রানির শিকার হতে হয়। শুধু কি তাই, দালালরা উন্নত চিকিৎসার কথা বলে ভুঁইফোঁড় ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসার নামে অনেক সময় রোগীর অঙ্গহানির ঘটনাও ঘটিয়েছে। পঙ্গু হাসপাতালের প্রত্যেক জায়গাতেই চলছে দালালের আধিপত্য। জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে কেবিন, ওয়ার্ড, প্যাথলজি বিভাগ, অপারেশন থিয়েটারসহ বহির্বিভাগ পর্যন্ত দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। টাকা ছাড়া কোনো রোগী এদের কাছ থেকে ন্যূনতম সেবাও পাচ্ছেন না। দালালদের কাছে ডাক্তাররা পর্যন্ত অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। এ ছাড়া উন্নত চিকিৎসার কথা বলে প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী ভাগিয়ে নেয়ায় কমিশন তো রয়েছেই। ফলে দালালদের দৌরাত্ম্যের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল)। আর এসব দালালের বস পঙ্গু হাসপাতালের কিছু অসাধু চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী।
গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে দালালচক্রের ১১ সদস্যকে গ্রেফতার করেছেন র?্যাব-২-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় আটকদের ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদ দেন র?্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। দালালরা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বিভিন্ন প্রলোভনে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভালো চিকিৎসকের কথা বলে নিয়ে যেত। এ ছাড়াও বিভিন্ন বাহানায় তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিত হাজার হাজার টাকা। টাকা দিতে না পারলে করত হয়রানি। অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে দালালচক্রের ১১ সদস্যকে গ্রেফতার করে র?্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রত্যেককে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদ দেন র?্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু। রোগীদের হয়ারানি ও অন্য ক্লিনিকে ভাগিয়ে নেয়ার দায়ে তাদের এ দ দেয়া হয়েছে। এসব দালাল হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে ক্লিনিকে নিয়ে গেলেই দুই হাজার টাকা করে কমিশন পান বলে জানিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা।
দালালদের রোগী ভাগানোর কৌশল সম্পর্কে র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, করোনার আগে এই দালালরা নতুন কোনো রোগী পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হতে এলে তাদের বলত, ডাক্তাররা অবহেলা করে। ভালো চিকিৎসা করে না। ভর্তি হলেই হাত-পা কেটে ফেলে দেয়। আর এখন করোনাভাইরাসের প্রকোপ চলাকালে বলছে, পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে করোনা হতে পারে। চিকিৎসা ভালো পাওয়া যাবে না। পঙ্গু হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসকও দালালদের সাথে যুক্ত রয়েছে। চিকিৎসকরা নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তির জন্য গোপনে রোগীর স্বজনদের পরামর্শ দেয়। যা দালালদের কাজকে আরো সহজ করে দেয় বলে জানান অভিযানে থাকা র্যাবের এ কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, একবার কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করাতে পারলেই হলো। এরপর শুরু হয় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে টাকা আদায়ের পালা। আজ এটা তো কাল অন্যটা। এভাবেই তারা এ অপকর্ম করে আসছিল। এই প্রতারণার সাথে জড়িত বাকিদেরও খুঁজে বের করা হবে বলে জানান র্যাব-২ এর তদন্ত কর্মকর্তারা।
সবুজ মিয়া নামে এক ভুক্তভোগী জানান, পায়ে সমস্যার কারণে গত কয়েক দিন আগে তিনি তার অসুস্থ বাবাকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে আসেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পা কাটার ভয় দেখিয়ে বাবাকে পঙ্গুতে রেখে উন্নত চিকিৎসার কথা বলে আমায় নিয়ে যাওয়া হয় নূর জাহান ক্লিনিকে। সেখানে বলা হয়, বাবার পায়ে চিকিৎসায় এক লাখ টাকা লাগবে। তখন আমি বলি, আপনারা কতটুক নিশ্চয়তা দিবেন যে এক লাখ টাকা দিলেই আমার বাবা ভালো হয়ে যাবে। তখন তারা বলে, কোনো নিশ্চয়তা দেয়া হবে না।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য, হাসপাতালের মূল প্রাঙ্গণ পর্যন্ত সেবাপ্রত্যাশীরা পৌঁছাতে পারছেন না এমন অভিযোগ আসছে। সেবাপ্রত্যাশীদের হাসপাতালের গেট থেকে দালাল চক্র ব্রেন ওয়াশ করে অন্যত্র নিয়ে যায়। তাদেরকে বলা হয়, ওই সব হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে উন্নত চিকিৎসাসেবা দেয়া যাবে। মানুষ সেটা বিশ্বাস করে যায়। বাস্তবতা হলো ওইসব জায়গায় কোনো সনদপ্রাপ্ত বা অভিজ্ঞ ডাক্তার থাকেন না। পরবর্তী সময়ে তাদেরকে বিরাট অঙ্কের একটি বিল ধরিয়ে দেয়া হয়।
পঙ্গু হাসপাতালে হয়রানি নিয়ে আবদুর রহমান নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, এই হাসপাতালে কিছু চিকিৎসক ইচ্ছে করে রোগী দেখেন না, ভালো কেয়ার নেন না। তারা চান তাদের ব্যক্তিগত ক্লিনিকগুলোয় রোগীরা চিকিৎসা নিক। রোগী মারা গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন রোগীরা এখানে অবহেলায় পড়ে থাকেন। ডাক্তারদের টার্গেট থাকে কিভাবে দালালের মাধ্যমে রোগীকে নিজ ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া যায়। দালালদের সিন্ডিকেট পরিচালনাও করেন হাসপাতালের ডাক্তাররা।
এ দিকে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সাগর নামে একজন জানান, তিনি লাইফ কেয়ার হাসপাতাল নামে একটি হাসপাতালের মার্কেটিংয়ে কাজ করেন। তার দায়িত্ব জাতীয় অর্থোপেডিক্স হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) থেকে রোগী ভাগিয়ে লাইফ কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। এর বিনিময়ে বেতনের বাইরেও রোগীপ্রতি টাকা পান তিনি। এর আগে চলতি বছরের ১৩ মে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে দুই রোগীকে ভাগিয়ে নিয়ে প্রাইম হাসপাতালে ভর্তি করানোর সময় হাতেনাতে ১০ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব-২। পরবর্তীতে ২২ লাখ টাকা জরিমানা ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এ ছাড়াও চলতি বছরের ১৬ জুন রোগী ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগে পঙ্গু হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ দিয়েছেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু। বছরে বেশ কয়েকবার অভিযান চালালেও পঙ্গু হাসপাতাল থেকে দালালদের দৌরাত্ম্য কমানো যাচ্ছে না কিছুতেই।

 


আরো সংবাদ



premium cement