১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চলনবিলে মাছ-পাখি ও শাপলার দুর্বার আকর্ষণ

পাখির কলরবে মুখরিত চলনবিল : নয়া দিগন্ত -

চলনবিল মানেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে হরেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আর মাছের সমারোহ। একই সাথে বছরজুড়ে দেশী প্রজাতির পাখিদের নিত্য আনাগোনা। মাছ-পাখির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী চলনবিল আরো একটি কারণে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। বর্ষা-শরৎ ও হেমন্ত মওসুমে বিলজুড়ে ফোটে নানা প্রজাতির শাপলা ফুল ও গুল্মলতা। এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল ও বেগুনি শাপলা ফুলের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। বর্ষা মওসুমে বিল-নদীতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় শাপলা। আবহমান কাল থেকেই শাপলা মানুষের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। হাট-বাজারে পাওয়া যেত শাপলা ফুলের মধু (পদ্ম মধু) শালুক আর ঢেপের খইয়ের মোয়া। চলনবিলাঞ্চলের স্বল্প আয়ের অভাবী মানুষ বিল থেকে পদ্ম মধু, শাপলা-শালুক ও মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন শুকনো মওসুমে বিল-নদী-জলা শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির শাপলা, গুল্মলতা, মাছ ও জলজপ্রাণী।
‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ বই থেকে জানা যায়, এক সময় নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। ১৯৬৭ সালে এম এ হামিদ টি কে ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকত। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে।
কয়েক বছর আগেও চলনবিলের ছয়আনিবিল, বাঁইড়ারবিল, সাধুগাড়ীবিল, সাঁতৈলবিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাকড়ারবিল, কচুগাড়ীবিল, চাতরারবিল, নিহলগাড়ীবিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়িবিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়িবিল, খৈগাড়িবিল, বৃগরিলাবিল, দিগদাড়িয়াবিল, খুলুগাড়িবিল, কচিয়ারবিল, কাশীয়ারবিল, ধলারবিল, ধরইলবিল, আমদাকুরীবিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরীবিল, রঘুকদমা বিল, কুমীরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়িবিল, রহুয়াবিল, সোনাডাঙ্গা বিল, কাতলবিল, বাঘমারা বিল, চিরলবিল, ডিকশীবিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, পাতিয়াবিল, চিনাডাঙ্গী, আইড়মারীবিল, কৈখোলাবিল, কানচগাড়ীবিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গাবিল, মেরীগাছাবিল, খলিশাগাড়ীর বিলে পাওয়া যেত নানা প্রজাতির প্রচুর শাপলা ফুল।
এ ছাড়া চলনবিলের আত্রাই, গুড়, করতোয়া, ফুলঝোর, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, তেলকুপী (মরা আত্রাই), নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা- বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বাঁকাই খাড়ি, গোহালা নদী, গাঁড়াবাড়ী-ছারুখালী খাল, বিলসূর্য নদী, কুমারডাঙ্গা নদী, জানিগাছার জোলা, বেহুলার খাড়িতে এখনো নানা রঙের শাপলার অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়।
স্থানীয় মানুষের মতে, চলনবিলে বালিহাঁস, ভূতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, সনালি, গুটি ঈগল, কুড়া ঈগল, কাস্তেচড়া, পান ভুলানি, কালিম, টিটি, পেডিসহ ১৫ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে। তবে এর মধ্যে বালিহাঁসের আধিক্য বেশি। এসব পরিযায়ী পাখি ছাড়াও সাদা বক, কানি বক, পানকৌড়ি, চিল, বাজপাখিসহ দেশীয় প্রজাতির নানা পাখি রয়েছে।
বর্ষাকাল শুরু থেকে শরৎকালের শেষভাগ পর্যন্ত বিশাল চলনবিলে মাইলের পর মাইল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত নয়নাভিরাম লাল, বেগুনি ও সাদা শাপলা। বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশিরভেজা রোদমাখা সকালে বিলে চোখ পড়লে রঙবেরঙের শাপলার বাহারি রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। বিলে শাপলার নয়নাভিরাম এ দৃশ্য দেখার জন্য ছুটে আসতেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। এখনো বিলপাড়ের অনেকেই নৌকা নিয়ে বিল থেকে শাপলা তুলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
জানা যায়, সাদা বর্ণের শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ। ছোটদের কাছে শাপলা ফুল খুবই প্রিয়। বাড়তি জনসংখ্যার চাপে বিল বাঁওড় জমি ভরাট করে বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। জমিতে উচ্চফলনশীল জাতের ফসল আবাদে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, অবৈধ দখল ও শুকিয়ে যাওয়ার কারণে চলনবিল থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে শাপলা ফুল। এখন খাল-বিল-জলাশয় থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা। আগে অনেকে সৌন্দর্যের জন্য পুকুরে চাষ করতেন লাল শাপলা। এখন পুকুরে বিদেশী কার্প জাতীয় মাছ চাষ হওয়ায় বেগুনি ও লাল শাপলা বিলুপ্তির পথে।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. সামিউল হক জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম শাপলা লতায় রয়েছে খনিজপদার্থ ১.৩ গ্রাম, আঁশ ৮.৭ গ্রাম, খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলোগ্রাম, ক্যালোরি-প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.৩২, ড্রাইমেটার ৮.৪, ক্রড আমিষ ১৬.৮, ক্রড ফ্যাট ২.৮, ক্রড ফাইবার ৬২.৩, নাইট্রোজেন ৩৫.৪, সোডিয়াম ১.১৯, পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ। অতীতকাল থেকেই শাপলার ফল দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খই ভাজা হয়। যেটি গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে ঢ্যাপের খই নামে পরিচিত। শাপলার মাটির নিচের মূল অংশকে (রাউজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিলের পানি কমে যায় তখন অভাবী মানুষ শালুক তুলে বাজারে বিক্রি করে। সেদ্ধ শালুক বেশ সুস্বাদু। শাপলা চুলকানি ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। ডায়াবেটি, বুকজ্বালা, লিভার, ইউরিনারি সমস্যা ও নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রণে লাল শাপলা খুবই উপকারী।
কৃষিবিদ মো: ইসমাইল হোসেন জানান, শাপলা তিন প্রকারের হয়ে থাকে। সাদা বেগুনি ও লাল রঙের। এর মধ্যে সাদা ফুলবিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ওষুধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি। সাধারণ শাক-সবজির চেয়ে শাপলার পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি। খাল বিল জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে শাপলা জন্মানো ও দেশী মাছের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
মাতৃভূমি রক্ষা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য : সেনাপ্রধান ব্রিটিশ হাই কমিশনারের সাথে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ১ হাজার টাকার জন্য পেশাদার ছিনতাইকারীরা খুন করে ভ্যানচালক হারুনকে দেশের মানুষ পরিবর্তন চায় : মতিউর রহমান আকন্দ টানা ১১ জয়ে ডিপিএলের প্রথম পর্ব শেষ করলো আবাহনী দেশে করোনায় আরো একজনের মৃত্যু উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনের অংশ নিতে মানা সবল-দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার কাজ শেষ হতে কত দিন লাগবে? জনগণের শক্তির কাছে আ'লীগকে পরাজয় বরণ করতেই হবে : মির্জা ফখরুল টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় মেরিনা তাবাসসুম বিএনপি নেতারা সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেয়ার অপচেষ্টা করছে : ওবায়দুল কাদের

সকল