২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জমির বিরোধে ভেদরগঞ্জে নির্যাতনের শিকার এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার

-

মধ্যযোগীয় নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে ভেদরগঞ্জ এলাকায় প্রতিবেশীর মাধ্যমে এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে নির্যাতন করার দৃশ্য। এই মুক্তিযোদ্ধার বাবার নামে বাড়ির দলিল ও রেকর্ড থাকলেও প্রভাবশালী ওই প্রতিবেশীর দায়ের করা একের পর এক দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি ও দেওয়ানি মামলার কারণে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় বন্দী জীবন কাটাচ্ছে ওই পরিবারটি।
দীর্ঘ দিনের জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিবেশী শের আলী সরদার নামে এই ব্যক্তির দ্বারা শুধু মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলাই নয়, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অসহায় জীবনযাপন করছে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল বেপারীর পরিবার। শের আলী সরদারের দায়ের করা প্রতিটি মামলা আদালত থেকে এই মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে রায় দেয়া সত্ত্বেও মালিকানা জমিতে ঘর তুলতে পারছেন না মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল। এমনকি একটি গাছ লাগানো বা কাটতেও পারছেন না তিনি। বর্তমানে বসবাসের অযোগ্য একটি ঘরে স্ত্রী-সন্তান ও নাতি-নাতনীদের নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে ওই মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। এই নির্যাতনের বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাদেরকেও মামলায় জড়ানোর হুমকি দিচ্ছেন শের আলী। জনশ্রুতিও রয়েছে শের আলী সরদার সমাজবিরোধী কার্যকলাপ ও অবৈধ ব্যবসার দায়ে একাধিকবার জেল-জরিমানার শিকার হয়েছেন। এর পরেও তার নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারসহ প্রতিবেশীদের। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সব অভিযোগের কথা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিলের পরিবার ও প্রতিবেশীরা। তবে আব্দুল জলিল বেপারীর অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে শের আলী তার পৈতৃক জমি ফিরে পেতে একের পর এক মামলা করেছে বলে শিকার করেছে।
এ বিষয়ে ভেদরগঞ্জ থানার সদ্য যোগদানকৃত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি খোঁজ খবর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে প্রয়োজনীয় আইনগত সহযোগিতা করব।
মুক্তিযোদ্ধার পরিবার, স্থানীয় ব্যক্তি ও মামলার সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর জেলাধীন ভেদরগঞ্জ উপজেলার কোড়ালতলী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল বেপারীর পিতা সিকিম আলী বেপারী। সিকিম আলী বেপারী একই এলাকার করিম বক্স হাওলাদর ও রহিম বক্স হাওলাদারের কাছ থেকে কোড়ালতলী মৌজার ৪২৩ নং দাগের ৪০ শতাংশ জমি থেকে ১৯৫৩ সালে সাবকবলা ১২৭ নং দলিল ও ১৯৫৫ সালের ৩৯১৫ নং দলিলের মাধ্যমে ২৭ শতাংশ জমির মালিক হন। একই দাগের অপর ১৩ শতাংশ জমি আব্দুল মজিদ হাওলাদার-এর কাছ থেকে ১৯৫৫ সালের একই দিন দলিল করে মালিক হন শের আলী সরদারের পিতা তৈয়ব আলী সরদার। পরবর্তীতে এসএ রেকর্ডে সেই সম্পত্তি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল বেপারী পিতা সিকিম আলী বেপারী ও শের আলী সরদারের পিতা তৈয়ব আলী বেপারীর নামে রেকর্ড হয়। রেকর্ডের মন্তব্যের কলামে ভুলবশত শের আলী সরদারের পিতার নামে সমুদয় ৪০ শতাংশ জমি দেখানো হয়। তার পরে কালক্রমে সেই জমি বাংলাদেশ সরকারের নামে চলে যায়। ১৯৮০ সালে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল বেপারীর পিতা সিকিমালী বেপারী ও শের আলী সরদারের পিতা তৈয়ব আলী সরদার সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসককে বিবাদি করে দেওয়ানি ৬৫ নং মামলা দায়ের করেন। ১৯৮৪ সালে সেই মামলায় আদালত সিকিমালী বেপারী ও তৈয়ব আলী সরদারের পক্ষে রায় ঘোষণা করেন। সেই থেকে দীর্ঘ ২৮ বছর পরে তৈয়বালী সরদারের ছেলে শের আলী সরদার সিকিমালী বেপারীর পুত্র মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল বেপারীকে বিবাদি করে দেওয়নি ০৮/২০১৪ নং মামলা দায়ের করে সমুদয় জমি দাবি করেন। সেই মামলার রায়ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল বেপারীর পক্ষে যায়। তারপর থেকেই শের আলী সরদার মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের প্রতি একাধিক দেওয়ানি, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় ও দণ্ডবিধি আইনে চাঁদাবাজি মামলা দিয়ে হয়রানি করে আসছে। সেখানেই থেমে থাকেনি শের আলী সরদার, ভাড়াটে সন্ত্রাসী, নিজে ও তার সন্তানদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারের উপর নির্যাতনও করেছেন একাধিকবার। এই বিষয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও থানা পুলিশ একাধিক সালিস দরবার করে বিরোধ মীমাংসার সিদ্ধান্তে পৌঁছে। কিন্তু শের আলী সরদার সালিসকারকদের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে পুনরায় মামলা মোকদ্দমায় জড়ান।
বিরোধ মীমাংসার সালিসকার শাহ আলম হাওলাদার বলেন, ভেদরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি তোফাজ্জাল মোড়ল, স্থানীয় গণ্যমান্য বাশার চোকদার, আলী আকবর মাস্টারসহ উভয় পক্ষের উকিল ও থানার ওসিকে নিয়ে থানায় সালিস করা হয়। সেখানে জমির কাগজপত্র পর্যালোচনা করে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। উভয় পক্ষ সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। শের আলী সরদার পরে আবার মুক্তিযোদ্ধা ও তার স্ত্রীকে মারধর করে নিজেই আবার তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করেন।
প্রতিবেশী হাজী নুরুল ইসলাম হাওলাদার (৮০) বলেন, শের আলী সরদার একজন ক্রিমানাল। সে ভেগরগঞ্জ বাজারে হোটেল শের আলী নামের আবাসিক হোটেলে নারী ব্যবসা করে। ইতোমধ্যে অনৈতিক কার্যকলাপের দায়ে তার একাধিকবার জেল-জরিমানাও হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা জলিল বেপারী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই তবুও তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলা করে হয়রানি করছে। সালিস দরবারে বসলে সবই মানে, পরবর্তীতে আবার নির্যাতন শুরু করে। আমরা প্রতিবাদ করতে সাহস পাই না।
প্রতিবেশী নুরুল ইসলাম সরদার (৭৫) বলেন, আমি ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেখছি এই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা অব্দুল জলিল বেপারীর পিতা বসবাস করে আসছেন। তাদের ঘরটি ঝড়ে ভেঙে পড়ার পর শের আলী সরদার আর ঘর তুলতে দিচ্ছে না। জলিল বেপারী লোক হিসেবে সমাজের চোখে ভালো। সে বা তার সন্তানদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নাম বা খারাপ কাজ করার ইতিহাস নেই। এই পরিবার বা তার সন্তানদের বিরুদ্ধে শের আলী সরদার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যা মামলা করছে।
মোশারফ হোসেন (৫০) বলেন, মুক্তিযোদ্ধা জলিল বেপারী আমার প্রতিবেশী। তার বসত বাড়ি সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। এখানে তার বাড়ি-ঘর ও বাবা-মায়ের কবরও আছে। জমির কাগজপত্র ও মালিকানা সবই সঠিক। তবুও শের আলী নামে তার প্রতিবেশী একের পর এক মামলা করে হয়রানি করছে। আদালত কাগজপত্র দেখে জলিল বেপারীর নামে রায় দেন। কারণ কাগজপত্র হলো জমির বাবা-মা। তবুও শের আলী সরদার এই নিরীহ পরিবারটিকে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসছে।
মুক্তিযোদ্ধা জলিল বেপারীর ছেলে সালাউদ্দিন, আলাউদ্দিন ও মেয়ে নাজমা জানান, তারা দুই ভাই ঢাকায় থেকে ভ্যান গাড়িতে নিয়ে কাঁচামালের ব্যবসা করেন। আর বোন বরিশালের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ছোট পদে চাকরি করেন। তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে প্রতিবেশী শের আলী তার বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে একাধিকবার মারধর করেছে। তাদের জমি থেকে গাছপালা ও বাঁশ কেটে নেয় শের আলী সরদার। বাঁধা দিলেই তাদেরসহ তার পিতা-মাতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ হয়রানিমূলক মামলা করে।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল বেপারী বলেন, ৭০ বছর ধরে এই বাড়িতে বসবাস করি। আমার পিতার নামে দলিল ও রেকর্ড আছে, আদালতের রায় আছে। গাছের একটা পাতা ধরলেও মারতে আসে। এই পর্যন্ত আমার হাত-পাঁ ভেঙেছে, মাথায় কোপ দিয়েছে। আদালতে যতগুলো মামলা করেছে তার সবগুলোর রায় আমার পক্ষে হয়েছে। তার পরেও চাঁদাবাজি মামলা করা শুরু করেছে। এই পর্যন্ত তিনটা চাঁদাবাজি মামলা করেছে, যার পক্ষে শের আলী সরদার কোনো রিপোর্ট পায়নি। মামলায় উল্লেখ করেছে মুক্তিযোদ্ধার সাইনবোর্ড বিক্রি করে আমি চাঁদাবাজি করি। পরে আদালতে নারাজি দিয়ে মামলা সিআইডিতে নিয়েছে। সিআইডি অফিসে আমাকে ডেকে নেয় সেখানেও শের আলী আমাকে মারতে আসে। আমি কোথাও ন্যায়বিচার পাইনি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারপ্রধানের কাছে ন্যায়বিচার দাবি করছি।
শের আলী সরদার বলেন, আমি মামলা করেছি। কারণ ৬০ বছর আগে থেকে আমার বাবার নামে দলিল ও রেকর্ড রয়েছে। সেই জমিতে সাইনবোর্ড লাগাইছে। এ জন্য আমি চাঁদাবাজি মামলাও করেছি। আমার নামেও জলিল সরদার একাধিক মামলা করেছে। জলিল বেপারী যে মামলায় আদালত থেকে রায় পেয়েছে, সে রায়ের বিরুদ্ধে আমি আপিল করেছি।
এই বিষয়ে ভেদরগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, আমার কাছে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল বেপারী একটি মৌখিক অভিযোগ করেছেন। শুনেছি এই জমি নিয়ে আদালতে মামলাও রয়েছে। এই বিষয়ে যদি লিখিত অভিযোগ করেন তাহলে উভয় পক্ষকে ডেকে আইনগতভাবে একটা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

 


আরো সংবাদ



premium cement