২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খেলাপি নীতিমালা আবারো শিথিল

ব্যাংকাররা দুশ্চিন্তায়
-

ঋণখেলাপির নীতিমালা শিথিলতার সময়সীমা তিন মাস বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ আরো তিন মাস পরিশোধ না করেও খেলাপি হওয়া থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন ঋণগ্রহীতারা। এর ফলে টানা এক বছর তারা ঋণ পরিশোধ না করার সুযোগ পেলেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গতকাল এক সার্কুলার জারি করা হয়েছে। গতকালই তা ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ দিকে নীতিমালা শিথিলতার সময়সীমা বাড়ানোয় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন ব্যাংকাররা; তবে অনেকটা স্বস্তিতে আছেন ঋণখেলাপিরা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত জানুয়ারি থেকেই ঋণখেলাপি নীতিমালায় ছাড় দেয়া হচ্ছে। প্রথমে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত, পরে সময় বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এ সময়ে ছোট বড় প্রায় সব ধরনের ঋণগ্রহীতারাই ঋণ পরিশোধ করছেন না। এমনিতেই খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে বিভিন্নভাবে ছাড় দেয়ায় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এক ধরনের অনীহা বিরাজ করছে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের মধ্যে এর পরও ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়ায় আরো সুযোগ পেয়ে যান ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরা। ফলে এত দিন ব্যাংকের কোনো ঋণ আদায় হচ্ছে না বললেই চলে। বিপরীতে আমানত প্রত্যাহারের চাপ বেড়ে গেছে। এতে ব্যাংকের আয় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। ব্যাংকাররা আশা করেছিল, সেপ্টেম্বরের পরে তারা ঋণ আদায় করতে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু আরো তিন মাস সময় দেয়ায় পুরো বছরই কোনো কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ না করেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। এতে ব্যাংকগুলো চরম বেকায়দায় পড়ে গেছে।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক জারিকৃত সার্কুলারে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অর্থনীতির বেশির ভাগ খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা থাকায় অনেক শিল্প, সেবা ও ব্যবসা খাত তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনার নেতিবাচক প্রভাব সহনীয় মাত্রায় রাখতে ঋণখেলাপি নীতিমালা শিথিলতা তিন মাস সময় বাড়ানো হয়েছে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, গত ১ জানুয়ারিতে ঋণ বা বিনিয়োগের শ্রেণীমান যা ছিল, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা অপেক্ষা বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। তবে কোনো ঋণ বা বিনিয়োগের শ্রেণীমানে উন্নীত হলে তা যথাযথ নিয়মে শ্রেণিকরণ করা যাবে। এ সময়ের মধ্যে ঋণ/বিনিয়োগের ওপর কোনো রকম দণ্ড, সুদ বা অতিরিক্ত ফি (যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) আরোপ করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো গ্রাহক স্বেচ্ছায় মেয়াদি ঋণ (স্বল্পমেয়াদি কৃষি ঋণ ও ক্ষুদ্র ঋণসহ) কিস্তি পরিশোধ এবং চলতি ও তলবি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ব্যাংক কর্তৃক যৌক্তিক রিবেট সুবিধা প্রদান করা যাবে। কিস্তি পরিশোধের জন্য বর্ধিত সময়ের সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের ওপর আরোপিত সুদ আয় খাতে স্থানান্তরকরণ এবং ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের বিষয়ে পরে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হবে।
বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, প্রায় সব খাতই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বলা চলে এক টানা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ ব্যাংক লেনদেন সীমিত হয়ে পড়ে। এর পরেও ওষুধ কোম্পানিগুলোর এ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হয়েছে। একই সাথে আইটি খাতের ব্যবসাও সচল ছিল। মে মাসের পর থেকে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদেরও ভালো ব্যবসা চলছে। এখন তো প্রায় সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। কিন্তু গত জুনের পর ঢালাওভাবে ঋণপরিশোধের শিথিলতা তিন মাস বাড়ানো হয়। অথচ ওষুধ, আইটি, ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আগের চেয়েও ভালো ছিল। এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ব্যাংকারদের সাথে আলাপ করে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু ব্যবসায়ীদের অনুরোধ রাখা হয়। এখন সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পরেও ঋণ পরিশোধের শিথিলতা আবারো বাড়ানো হলো যা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ, ব্যাংকগুলোর প্রধান কাজ হলো আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে তা ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে বিতরণ করা। গ্রাহক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করলে আবার তা নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করা হয়। এভাবেই নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে। বেড়ে যায় কর্মসংস্থান। আর কর্মসংস্থান বাড়লে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায়। এভাবেই ব্যাংকের বিনিয়োগ জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সুযোগ দেয়ায় যারা ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম ছিলেন তারাও ঋণ পরিশোধ করছেন না। এতে গ্রাহকের ব্যাংকের ঋণ কমছে না বরং সুদে-আসলে তা বেড়ে যাচ্ছে। আবারো তিন মাস সময় দেয়ায় টানা এক বছর ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ হচ্ছে না। জানুয়ারিতে ব্যবসায়ীরা কয়টা কিস্তি পরিশোধ করবেন। কারণ, ইতোমধ্যে তাদের সব ঋণই পরিশোধ না হওয়ায় অনাদায়ী হয়ে পড়েছে। জানুয়ারিতে ওই মাসসহ ১০ থেকে ১২টি ঋণের কিস্তি এক সাথে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই তা পারবেন না। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হঠাৎ করেই কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এতে শুধু ব্যাংকিং খাতেই বিপর্যয় নেমে আসবে না, পুরো অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।


আরো সংবাদ



premium cement