২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে পাসপোর্টের সৌদি চাপ কি মানবে বাংলাদেশ

-

সৌদি আরব সে দেশে অবস্থানরত ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিতে যে চাপ দিচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ রাজি নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এমন ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন যাদের কোনো ডকুমেন্ট নেই তাদের কেন বাংলাদেশ পাসপোর্ট দেবে।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, পাসপোর্ট দেয়া না হলে সৌদি আরবে কর্মরত অভিবাসী বাংলাদেশীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয়া হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে সৌদি সরকারের বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেয়া বা না দেয়ার ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে কি নাÑ এই প্রশ্নও সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে। একই সাথে সৌদি আরবে থাকা কমপক্ষে ২২ লাখ বাংলাদেশীর জন্য বিষয়টি কোনো হুমকি তৈরি করবে কি নাÑ এ নিয়েও নানা আলোচনা চলছে।
পাসপোর্ট ইস্যুতে কী আলোচনা?
সৌদি আরবে বাংলাদেশের দূতাবাসে নতুন একজন রাষ্ট্রদূত যোগদান করেছেন অল্প কিছুদিন আগে। তার সাথে প্রথম বৈঠকেই সৌদি কর্তৃপক্ষ সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘সৌদি আরব বলেছে যে তাদের দেশে স্টেটলেস লোক তারা রাখে না। তাদের দেশে থাকা ৫৪ হাজার রোহিঙ্গার কোনো পাসপোর্ট নেই। তারা বলেছে, তোমাদের বাংলাদেশ থেকেতো রোহিঙ্গা অনেকে এখানে এসেছে, সুতরাং তোমরা যদি এদের পাসপোর্ট ইস্যু করো।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা বলেছি যে, ওদের যদি আগে কখনো বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকে কিংবা যদি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারে, তাহলে আমরা অবশ্যই তাদের পাসপোর্ট ইস্যু করব। অন্যথায় আমরা কিভাবে করি? তখন তারা বলেছে, পাসপোর্ট ইস্যুর অর্থ এই নয় যে আমরা তাদের তোমাদের দেশে বিতাড়িত করব। তারা বলেছে, যেহেতু স্টেটলেস লোক সৌদি আরবে রাখা হয় না, সে জন্য পাসপোর্ট দিতে বলছি।’ যাদের বাংলাদেশের কোনো ডকুমেন্ট নেই, তাদের আমরা পাসপোর্ট দেবো কেন? আমরা তাদের বলেছি, তোমরা মিয়ানমারের সাথে এটা নিয়ে কথা বলো। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের বক্তব্য হচ্ছে, সৌদি আরবই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছিল।
১৯৭৭ সালে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নির্যাতিত হচ্ছিল, তখন তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ঘোষণা করলেন যে, তিনি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবেন। তাই অনেক রোহিঙ্গা সৌদি আরবে যায়। এরা ৩০ বা ৪০ বছর ধরে ওই দেশে আছে। ওদের ছেলেমেয়েরা সেখানে জন্ম হয়েছে। কিন্তু ওদের কোনো পাসপোর্ট নেই। মি. মোমেন জানান ‘এর আগে ৪৬২ জন রোহিঙ্গাকে যারা সৌদি আরবে জেলে আছে, তাদের বাংলাদেশে আনার জন্য বলেছিল। সেখানে বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা যাচাই করে দেখেছেন যে জেলে থাকাদের মধ্যে ৭০ বা ৮০ জনের মনে হয় বাংলাদেশের পাসপোর্ট ছিল। বাকিদের ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না। যাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট ছিল, আমরা তাদের ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট দিয়ে নিয়ে আসব। কিন্তু যাদের নেই, তাদের আমরা আনবো কেন?’ এই প্রশ্ন তিনি করেন।
একজন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, সৌদিতে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেয়া হলে, সেটা মিয়ানমার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার তখন বলতে পারবে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের লোক। ফলে সৌদির প্রস্তাব অনুযায়ী পাসপোর্ট দেয়া ঠিক হবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও এমন ইঙ্গিত আসছে।
বিষয়টি এখন উঠছে কেন?
পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে সৌদি আরবে বাংলাদেশের দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত ছিলেন গোলাম মসিহ। নতুন রাষ্ট্রদূত সেখানে যোগ দেয়ার পর তিনি দেশে ফিরেছেন।
মি. মসিহ বলেছেন, ‘বিভিন্ন সময় যখন অবৈধ লোকজন ফেরত পাঠানোর প্রশ্ন আসে, তখন তারা রোহিঙ্গা হিসেবেতো বলে না। তারা বলে তোমাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে এসেছিল, তখন আমরা যাচাই করে ব্যবস্থা নেই। এটা চলমান বিষয়।’
একই সাথে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা যে ইস্যুটা ইদানীং বলছে, এটা কোনো সিরিয়াস সমস্যা হবে না।’ তবে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বিষয়টাকে দেখেন ভিন্নভাবে।
তিনি মনে করেন, সৌদি আরবের অর্থনীতি আগের মতো শক্তিশালী নেই। এখন রোহিঙ্গাদের নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের এই অবস্থানের ক্ষেত্রে সেটা একটা কারণ হতে পারে।
এখনকার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এমন হতে পারে যে তাদের ওখানে এমপ্লয়মেন্ট বা কাজের সুযোগ অনেক কমে আসবে। তারা এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে দেখছে যাতে এ রকম চাপ দিয়ে কিছু বিদেশী শ্রমিক কমিয়ে ফেলা যায়।
সৌদিতে ২২ লাখ বাংলাদেশী
চুয়ান্ন হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেয়া না হলে সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার একটা আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলছেন, ‘সেখানে উসকানি দেয়ার যথেষ্ট দুষ্ট লোক আছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌদি কর্তৃপক্ষের ভালো সম্পর্কের কারণে সেখানে এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করছে, যা প্রায় ২২ লাখ। কিন্তু অন্যান্য দেশ যারা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তারা কিন্তু খুব অসন্তুষ্ট। তাদেরও লোকজন সেখানে আছে, তো তারা বিভিন্ন রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন, এর আগেও দু’-একবার সৌদি আরব রোহিঙ্গাদের ইস্যু তুলেছে, কিন্তু তারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়Ñ এটাই বাংলাদেশের অবস্থান ছিল। কিন্তু তার কোনো প্রভাব শ্রমবাজারে পড়েনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মসিহ মনে করেন, রোহিঙ্গা ইস্যু সেখানে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, ২২ লাখ শ্রমিকের বিষয় যখন আসবে, তখন সৌদি চাপের মুখে বাংলাদেশ অবস্থানে অনড় থাকতে পারবে কি নাÑ সেই সন্দেহ তাদের রয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ে শিগগিরই দুই দেশের উচ্চপর্যায়ে একটি বৈঠক হতে পারে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
দুই দেশের সম্পর্ক
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সৌদি আরব এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন ভালো।
গোলাম মসিহর বক্তব্যও একই রকম। কিন্তু এখন সৌদি আরবের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আনার বিষয়কে সন্দেহের চোখে দেখছেন সাবেক কূটনীতিকদের অনেকে।
মি. হোসেন বলেছেন, ‘এই সময় তাদের এই চাপ প্রয়োগ, এটা খুবই দুঃখজনক। কারণ সৌদি আরব নিজেদের মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে দাবি করে। সেখানে তারা দেখছে যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে সঙ্কট চলছে। তখন তারা ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দেয়ার কথা বলছে।’
একইসাথে তিনি বলেন, সৌদি আরবের কোনো বিষয়েই সমর্থনের কোনো অভাব বা ঘাটতি দেখায়নি বাংলাদেশ। সেখানে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে তিনি মনে করেন।


আরো সংবাদ



premium cement