২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মিরসরাইয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের কালিজিরা ধান

-

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় কালিজিরা ধান স্থানীয় ভাষায় ‘গুয়া ধান’ হিসেবে বেশ পরিচিত। এক সময় উপজেলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল কালিজিরা ধান। উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভায় চাষ হতো কালিজিরা ধান। গ্রামীণ জীবনে এই ধানটি ছিল অপরিহার্য। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই ধানের জায়গা দখল করে নিয়েছে উচ্চফলনশীল জাতের ধান। প্রতিটি বাড়িতে সংরক্ষণ করা হতো কালিজিরা ধান। এই জাতের সুগন্ধি চালের নাম শুনলে কার মুখে রসনায় পানি না আসে। এই সুগন্ধি চিকন চাল দিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানে তৈরি হয় পিঠা-পুলি, পোলাও, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, ক্ষির, পায়েস, ফিরনি ও জর্দাসহ আরো সুস্বাদু মুখরোচক নানা ধরনের খাবার। এ ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন পূজা-পার্বণের ভোগ, মিষ্টান্ন রান্নার কাজে কালিজিরা চাল ব্যবহার করে। ফলে ধানটি সবার কাছেই বিশেষ প্রয়োজনীয়। কিন্তু এসবই এখন কালের স্মৃতি। উপজেলার অর্ধশতাধিক ছোট বড় হাটবাজারে এখন আর এই চাল পাওয়া যায় না। বিলুপ্তির পথে এই উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এ সুগন্ধি ধান। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী বাড়িতে জামাই এলে শ্বশুরবাড়িতে চিকন চালের ভাত দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। নি¤œ, মধ্য, গরিব হলেও দিনে একবেলা অবশ্যই একবার এই চালের ভাত রান্না হতো। এ ধান কাটার সময়কে ঘিরে গ্রামবাংলা মেতে উঠত নবান্নের উৎসবে। সেসব এখন অতীত দিনের স্মৃতি। বীজের অভাব, সার, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানান কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এ সুগন্ধি ধানের চাষাবাদ।
জানা গেছে, কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের সুগন্ধি ‘কালিজিরা’ ধান। বেশি খরচ, কম লাভের কারণে এই ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন মিরসরাই উপজেলার কৃষকরা। বিকল্প হিসেবে তারা চাষ করছেন ব্রি-ধান ৩৪। সরকারের কৃষি বিভাগের মাধ্যমে এই জাতের ধান আবাদে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা বা প্রদর্শনী প্লট প্রকল্প গ্রহণ করলে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির হাত থেকে তা ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশাবাদ কৃষকদের।
জানা গেছে, উপজেলার করেরহাট, হিঙ্গুলী, জোরারগঞ্জ, ওয়াহেদপুর, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিরসরাই সদর ইউনিয়নের কৃষিজমিগুলোতে দেখা যায়, এসব অঞ্চলের খুব কম জমিতে কালিজিরা ধান চাষ হয়েছে। এ সময় বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন জাতের ধান আবাদকারী কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই জাতের ধানের ফলন হয় কম। বিঘাপ্রতি অন্য জাতের ধান যেখানে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ মণ উৎপন্ন হয় সেখানে এই জাতের ফলন হয় সর্বোচ্চ ৮ মণ পর্যন্ত। তবে বাজারে দাম দ্বিগুণ পাওয়া যায়। সার, সেচ, পরিচর্যাও লাগে কম। সে হিসেবে আবাদে লোকসান হয় না বললেও চলে। এখনো গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের কাছে এই ধানের কদর যথেষ্ট। এখনো প্রতি কেজি এই জাতের ধানের চাল বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। তবে এই চাল সচরাচর সবখানে পাওয়া যায় না। মিরসরাই উপজেলায় কালিজিরা জাতের ধানের চাষে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ লক্ষ করা গেলেও বীজের অভাবে অনেকের পক্ষে আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। উপজেলায় ফসলের মাঠজুড়ে এখন শুধু সোনালি ধানের সমারোহ। তবে প্রত্যেক মাঠের মাঝখানে দোল খাচ্ছে দুই একটি জমিতে কালিজিরা জাতের ধানের থোকা থোকা কৃষ্ণবর্ণ শীষ। সারা মাঠের মধ্যে একখণ্ড এই ধানক্ষেত দূর থেকে দেখলে মনে হবে, এ যেন কোনো চিত্রশিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা ছবি। এই জাতের ধান সাধারণত কালো বর্ণের হয়। অন্য ধানের চেয়ে এর আকারও ছোট।
‘গুয়া ধানের (কালিজিরা ধান) চালের ভাত রান্না করলে মৌ মৌ গন্ধে চতুর্দিক ভইরা যাইত। এই ভাত এমনি এমনিই খাওয়া যাইত। গুয়া ধানের চাউলের ভাতের স্বাদের কথা জীবনেও ভুলতে পারবো না’Ñ এভাবেই গুয়া ধান (কালিজিরা ধান) নামক ধানের চালের স্বাদ ও সুগন্ধের কথা বলছিলেন মিরসরাইয়ের মধ্যম ওয়াহেদপুর গ্রামের কৃষক সাইফুল্লাহ।
দক্ষিণ মঘাদিয়া ঘোনা এলাকার চাষি আবদুল কাইয়ুম জানান, এক সময় প্রত্যেক চাষিই কম বেশি এই ধান চাষ করতেন। তিনি বলেন, আজ থেকে ১৫ বছর আগেও ১২০ শতক জমির মধ্যে ২০ শতকে কালিজিরা চাষ করতাম আমি। এখন করি ৪-৫ শতক জমিতে। এভাবে প্রত্যেক চাষিই এ ধানের চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। কেউ কেউ তো এই ধান চাষই করছেন না। হঠাৎ এই ধান চাষে কৃষকের আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এই ধানের ফলন অন্য ধানের চেয়ে অনেক কম। যে জমিতে আমন চাষ করে ৫ টন ধান পাওয়া যায় সে পরিমাণ জমিতে কালিজিরা ৩ টনও পাওয়া যায় না। তাই এই ধানে আশানুরূপ লাভ না হওয়ায় কৃষকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন।
মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রঘুনাথ নাহা বলেন, এক সময় এই ধান অনেক উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বেশি চাষ হতো। ফলন কম হওয়ায় এই ধান চাষে কৃষকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। বর্তমানে মিরসরাই উপজেলায় প্রায় ৫০ হেক্টরের মতো জমিতে এই ধান চাষ হয়। উচ্চফলনশীল জাতের ধানের চেয়ে এই ধানের ফলন কম হয় বিধায় কৃষকরা এই ধানের চাষ কম করেন। মিরসরাইয়ে এর বিকল্প হিসেবে ব্রি-ধান ৩৪ চাষ হচ্ছে। কৃষকরা নিজ আগ্রহে এই জাতের ধান চাষ করেন। এ ধানটি দেশীয় জাতের ধানের মধ্যে অন্যতম। এটি হুবহু কালিজিরার মতো এবং ফলনও বেশি। তাই কৃষক এই ধানের দিকে ঝুঁকছেন।


আরো সংবাদ



premium cement