২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাংলাদেশে ফুসফুস রোগের কারণ ও প্রতিকার

-

বাংলাদেশে ফুসফুসের প্রধান অসুখ যক্ষ্মা। এ ছাড়া বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের নানা রোগে অনেকেই আক্রান্ত হন। আর এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস।
বাংলাদেশে ফুসফুসের যেসব সমস্যা বেশি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০১৮ সালের ‘হেলথ বুলেটিন’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে অসংক্রামক ব্যাধিতে যাদের মৃত্যু হয় তার ১০% শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাজনিত কারণে। এই বুলেটিন অনুযায়ী, শিশু মৃত্যুর যে ১০টি প্রধান কারণ রয়েছে তার মধ্যে দুই নম্বরে রয়েছে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টজনিত রোগে। বাংলাদেশ লাঙ ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ডা: আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলছেন, বাংলাদেশে ফুসফুসের সবচেয়ে প্রধান রোগ হলো যক্ষ্মা।
এ ছাড়া হাঁপানি, ‘ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিস’ এবং শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণও অনেক বেশি। বায়ু দূষণের কারণে ফুসফুসের সমস্যায় অনেকেই আক্রান্ত হন। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের যক্ষ্মাবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে, যে দেশগুলোতে যক্ষ্মা রোগের হার সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে আক্রান্ত ছয়টি দেশের মধ্যে।
ডা: আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলছেন, এই অবস্থান প্রতি বছর মোটামুটি একই জায়গায় থাকে। বাংলাদেশে যুগযুগ ধরে যক্ষ্মার প্রবণতা এত বেশি কারণ, ‘বাংলাদেশ খুব ঘনবসতি। বাংলাদেশে সব জায়গায় এত ভিড় যে শ্বাসপ্রশ্বাসের রোগগুলো হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে একজনের থেকে আর একজনের শরীরে সংক্রমিত হওয়া খুব সহজ। যক্ষ্মায় আক্রান্ত একজন রোগী আরো দশজনকে আক্রান্ত করতে পারে।’ যক্ষ্মায় ছয় মাসের চিকিৎসা নিতে হয়। সব রোগী চিহ্নিত না করতে পারা, চিকিৎসা অসম্পন্ন রাখার কারণে রোগটি রয়ে যায়।
আর দারিদ্র্যের কারণে অনেকে চিকিৎসা নিতে যেতে পারেন না যদিও বাংলাদেশে কম খরচে এর চিকিৎসার যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে তিনি উল্লেখ করলেনÑ পরিচ্ছন্নতার ধারণার অভাব।
‘আমাদের দেশে হাঁচি ও কাশির যে এটিকেট -- মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে নেয়া, রুমাল না থাকলে বাহু দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁচি ও কাশি দেয়া-- সেই অভ্যাসটা বেশির ভাগের মধ্যেই নেই। এটা ভিড়ের মধ্যে ঘটলে চিন্তা করুন সংক্রমণ কত সহজে।
সিগারেট
ঢাকার বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে রেসপারেটরি মেডিসিনের চিকিৎসক ডা: রওশন আরা খানম বলছেন, ‘আপনি যদি এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের দিকে তাকান দেখবেন বিশেষ করে ঢাকা শহরে বায়ুর মান যত দিন যাচ্ছে খারাপ হচ্ছে। বায়ুতে ধুলো ও ধোঁয়ার কারণে শহরের আকাশ কেমন ঝাপসা দেখায়। হাঁপানির মতো শ্বাসকষ্ট এখন আমরা অনেক বেশি পাই।’
বছরের শেষের দিকে ইটের ভাটার চিমনি শুধু শহরে নয় গ্রামেও দূষণ তৈরি করে। যারা দূষিত বায়ু রয়েছে এমন পরিবেশে নিয়মিত লম্বা সময় কাজ করেন তাদের ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে।
যেমন যারা শহরের রাস্তায় বা ইটের ভাটায় কাজ করেন। ডা: রওশন আরা খানম বলছেন, ধুমপান ফুসফুসের অনেক বড় শত্রু। আমরা নতুন যে বিষয়টা পাচ্ছি, ‘ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিস’ মেয়েদের মধ্যে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে ইদানীং। এর একটি কারণ হচ্ছেÑ সরাসরি ধুমপান না করলেও ধুমপায়ীদের আশপাশে যারা থাকেন তাদেরও অনেক ক্ষতি হয়। মেয়েরাও ইদানীং আগের থেকে বেশি ধুমপান করছেন।
২০১৮ সালের গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশে চার কোটির বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজ বাড়িতেই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়।
ডা: রওশন আরা খানম আরো বলছেন, গ্রামের দিকে যে কাঠের চুলায় রান্না হয়, তার ধোঁয়া ফুসফুসের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর।
যেহেতু নারীরা চুলার খুব কাছে থাকেন, প্রতিদিন এবং লম্বা সময় ধরে তাই খুব সরাসরি এই ধোঁয়া তার ফুসফুসে প্রবেশ করে।
এ ছাড়া রয়েছে মশার কয়েলের ধোঁয়া যার ক্ষতিও কম নয়।
ডা: আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলছেন, করোনাভাইরাসের আক্রমণের প্রধান লক্ষবস্তু হচ্ছে ফুসফুস। শ্বাসতন্ত্র মানুষের শরীরে তার প্রবেশ পথ এবং করোনাভাইরাস ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে যায়। এমনকি সুস্থ ব্যক্তি যাদের ফুসফুসে কখনো কোনো সমস্যা ছিল না তারাও মারাত্মক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘করোনাভাইরাস ফুসফুসে একটা বড় তাণ্ডবলীলা করে যায় বলতে পারেন। কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের একটা বড় অংশের পালমোনারি ফাইব্রোসিস হচ্ছে। রোগটিতে যা ঘটে, ফুসফুসের কোষগুলোতে সে বাসা বাঁধে এবং সেখানেই তার প্রসার ঘটে। করোনাভাইরাস এই কোষগুলোর মারাত্মক ক্ষতি করে।’
মানুষের ফুসফুস নরম থাকার কথা। এতে সহজে ফুসফুসে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড যাওয়া আসা করে। কিন্তু ফাইব্রোসিস হয়ে গেলে ফুসফুস শক্ত আকার ধারণ করে। তখনই অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের যাওয়া আসা ব্যাহত হয়। কারণ ফুসফুসের থলিগুলো ফুলতে পারে না। রোগী একটি দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টে ভোগে।’
এ রোগ চিকিৎসার পর ফুসফুসকে তার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা যায় না।
ফুসফুস যেভাবে সুস্থ রাখবেন
শুধু করোনাভাইরাসের জন্য নয়; ফুসফুসকে সারা বছরই সুস্থ রাখতে চেষ্টা থাকা উচিত, বলছেন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা: কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর। তিনি বলছেন, ফুসফুস সুস্থ রাখতে সবচেয়ে বেশি দরকার নির্মল বায়ু। কিন্তু সেটি পাওয়া যেহেতু খুব সহজ নয় তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ফুসফুস সুস্থ রাখতে তিনি কয়েকটি উপায় বলছেন:
ধুমপান যত দ্রুত সম্ভব ত্যাগ করা : ধুমপান শুধু ফুসফুসের ক্ষতি নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গেরও ক্ষতি করে। ধুমপান ত্যাগ করলে পুরো শরীরের মঙ্গল।
সুষম খাদ্য গ্রহণ করা : শাকসবজি, ফল ও মাছ বিশেষ করে টক জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। লেবু, কমলা, মাল্টা, বাতাবি লেবু, আমড়া, বড়ই এই ধরনের টক জাতীয় ফল ফুসফুসের জন্য উপকারী।
ফুসফুসের জন্য উপকারী ভিটামিন : ফুসফুসে প্রতিনিয়ত যে ক্ষয় হয় সেজন্য ভিটামিন-সি, ডি এবং জিঙ্কযুক্ত খাবার খাওয়া খুব জরুরি।
করোনাভাইরাস : ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাতটি পরামর্শ
ডা: কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর বলছেন, স্কুলে শরীরচর্চার সময় যেমনটা করতেন তেমনটা দুই হাত আস্তে আস্তে একসাথে মাথার উপরে তুলতে হবে।
তোলার সময় মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হবে। দুই হাত প্রসারিত করে মাথার উপরে তুললে বক্ষ পিঞ্জর প্রসারিত হয়। এতে বেশি বাতাস প্রবেশ করে। মাথার ওপরে হাত কিছুক্ষণ রাখতে হবে। ১০ সেকেন্ডের মতো শ্বাস ধরে রাখতে হবে। এরপর হাত নামাতে হবে একই সাথে জোরের সাথে মুখ দিয়ে ধরে রাখা বাতাস ছেড়ে দিতে হবে।
এই ব্যায়াম সকাল ও বিকেল ১৫ মিনিট করার পরামর্শ দিচ্ছেন ডা: বেননুর।


আরো সংবাদ



premium cement