২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অপসংস্কৃতির ছোবল দেশীয় সংস্কৃতিতে

-

ভীনদেশী অপসংস্কৃতির ছোবলে হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। বিশেষ উৎসবগুলোতেও দিন দিন এর আগ্রাসন বেড়ে চলছে। নতুন প্রজন্ম নিজেদের স্বকীয়তা ভুলে গিয়ে বিদেশী সংস্কৃতি অনুসরণ করছে। যার কারণে আমাদের গৌরবের ভাষা, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, নবান্ন উৎসব, বৈশাখী মেলা, পৌষ পার্বনের পিঠার উৎসব, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বাংলার পালাগান অবহেলায়-অনাদরে আর পাশ্চাত্য সভ্যতার জাঁতাকলে প্রতিনিয়তই নিষ্পেষিত হচ্ছে। এর চেয়ে এখনকার তরুণদের মধ্যে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে হিন্দি ভাষা, থার্টিফাস্ট, ভ্যালেন্টাইন ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে, ফাদারডে, মাদারডে এসবের মতো বিদেশী সংস্কৃতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের টিভি মিডিয়ায় দেশীয় বিনোদনের অপ্রতুলতার কারণে যথেষ্ট মাত্রায় দর্শকদের চাহিদার শূন্য জায়গাটাকে দখল করে নিয়েছে বিদেশী সংস্কৃতি। এটা আমাদের নীতিনির্ধারক ব্যক্তি মহলের অসচেতনতার বহিঃপ্রকাশ। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতীদের মনন-মানসিকতা ওই অসুস্থ ধারার সংস্কৃতির ছোঁয়ায় বিভ্রান্তির পথে ঝুঁকে পড়ছে। তাদের একটা বিরাট অংশ আমাদের সংস্কৃতির প্রতি অনিহা পোষণ করে বিদেশী সংস্কৃতিকে বরণ করে নিয়েছে। যার কারণে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতির চেয়ে এখনকার তরুণদের মধ্যে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে বিদেশী নানান সংস্কৃতি। অভিবাবকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এগুলো সম্পূর্ণভাবে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী হওয়া।
অনুসন্ধান বলছে, আমাদের বাঙালির একসময় জগৎবিখ্যাত বেনারসি শাড়ি ছিল। কিন্তু কালের স্রোতে তাও হারিয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জকে বলা হতো প্রাচ্যের ড্যান্ডি। কিন্তু সবই আজ ইতিহাস। একসময় তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প, বুননশিল্প, কামারশিল্প, হস্ত শিল্প, কুটির শিল্পসহ নানারকমের শিল্প ছিল কিন্তু আজ এগুলো প্রায় অতীত হয়ে যাচ্ছে। শীতল পাটি, নকশিকাঁথা, বেতের কাজ, হাতপাখা এগুলোও আজ বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। দেশের বাজার এখন বিদেশী পণ্যে সয়লাব। আর এতে করে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে আমাদের দেশের মূল শিল্পগুলো। দেশের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এগুলোর ব্যবহার বা উৎপাদন হলেও নতুন প্রজন্মের মধ্যে তার ব্যবহার লক্ষ করা যায় না। এভাবেই ক্রমশ দেশের অনেক ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঘাটুগান, বৃহত্তর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জারি গান, সিলেটের মনিপুরী নাচ, উত্তরাঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানও হিন্দি গানের ছোবলে আজ বিলুপ্তপ্রায়। লোকজ শিল্প ঠাঁই পাচ্ছে জাদুঘরে। আজকালকার প্রজন্ম ইন্টানেট ডিশ অ্যান্টেনাসহ না ধরনের সহজলভ্য প্রযুক্তির প্রভাবে পশ্চিমা পপ গান, রকগান, হাওয়াইন গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। এতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নিজস্ব লোকজ সংস্কৃতি।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, বিদেশী সংস্কৃতির ব্যাপক আগ্রাসনের ফলে আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ ও খাদ্যাভাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তা ছাড়া এটি আমাদের জীবনবোধ, নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে ব্যাপক আঘাত হানছে। ফলশ্রুতিতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে সমাজে অন্যায়-অবিচার বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মতে, আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে কিছু কিছু টিভি চ্যানেলে এমন কিছু অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, যা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ও ভারতীয় কিছু টিভি চ্যানেল অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদেশী চ্যানেলগুলো অবাধে তাদের অনুষ্ঠানাদি সম্প্রচার করে যাচ্ছে। ফলে ইউরোপীয় চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানের কারণে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারের ফলে আমাদের ধর্মনিষ্ঠা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ পরাস্থ হচ্ছে। অপর দিকে ভারতীয় চ্যানেলগুলোও বিভিন্ন প্রকার অনুষ্ঠান ও সিরিয়াল প্রচারের মাধ্যমে আমাদের দেশের বিশেষ করে নারী সমাজকে পারিবারিক কোন্দলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোতে শেখানো হচ্ছে সাংসারিক অশান্তি। কূটচাল, হিংসা, লোভ-লালসা, বউ-শাশুড়ির পারিবারিক সঙ্ঘাতপূর্ণ এসব সিরিয়াল আমাদের দেশের অধিকাংশ নারীই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে উপভোগ করে থাকেন। পরবর্তী সময়ে টিভি সিরিয়ালের বিষয়বস্তুগুলো মনের অজান্তেই তাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এর ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে পরিবারগুলোর ভেতর পারিবারিক সঙ্ঘাত অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে আমাদের পরিবার ও সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।
বিশিষ্ট শিশু চিকিৎসক প্রফেসর তাহমিনার মতে, আমাদের কোমলমতি শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় টিভি ইন্টারনেট দেখা নাটক এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের দেহমনের ওপর প্রভাব পড়ে। এই অপসংস্কৃতি আমাদের জন্য ভয়াবহ অশুভ ভবিষ্যৎ ডেকে আনছে।
অপর দিকে বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলছেন, বর্তমান সময়ে ঘরে বসে বিশ^কে জানা একেবারে সহজ। তাই আমাদের নতুন প্রজন্ম যা দেখবে তাতে তারা প্রভাবিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ আমাদের প্রচার মাধ্যমে বিনোদনের অপ্রতুলতার কারণে সে জায়গাটাকে দখল করে নিয়েছে বিদেশী সংস্কৃতি। আমাদের একটা বিরাট অংশ আমাদের সংস্কৃতির প্রতি অনীহা পোষণ করে বিদেশী সংস্কৃতিকে বরণ করে নিয়েছে। যার কারণে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি চেয়ে এখনকার তরুণদের মধ্যে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে বিদেশী নানান সংস্কৃতি। এ দায় আমাদের নিতে হবে। অভিভাবকসমাজকে সচেতন হতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য দেশের সংস্কৃতির মতো আমাদেরও যে নিজস্ব সংস্কৃতি আছে তা তাদেরকে জানাতে হবে। নয়তো বিদেশী সংস্কৃতির ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

 


আরো সংবাদ



premium cement