১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সিজারে সন্তান জন্মদান

ক্লিনিক মালিকদের কাছে চিকিৎসকেরাও অসহায়

-

সিজারে সন্তান জন্মদানে ক্লিনিকের মালিকদের কাছে চিকিৎসকেরাও অসহায়। সিজার করতে না পারলে এবং মাকে অথবা অভিভাবকদের সিজার করাতে উদ্বুদ্ধ করাতে না পারলে ওই চিকিৎসককে ক্লিনিকে বসতে দেয়া হয় না। তবে এটা ঠিক এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় সিজার করতে অনাগ্রহী চিকিৎসকের সংখ্যা খুব বেশি না। অবস অ্যান্ড গাইনোকলজির বেশির ভাগ চিকিৎসকের বিরুদ্ধেই অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান করার অভিযোগ রয়েছে। নানা ধরনের কারণ দেখিয়ে মাকে অথবা অভিভাবকদের সিজারিয়ানে সন্তান জন্মদানে বাধ্য করা করেন তারা। বিনিময়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার টাকা চলে আসে চিকিৎসক ও ক্লিনিক মালিকের পকেটে।
এ ধরনের একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ কাজ করেন নরসিংদীতে। তিনি এ জেলার একটি সরকারি হাসপাতালে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই গাইনোকলজিস্ট নয়া দিগন্তের এ প্রতিবেদককে জানান, নরসিংদীর বেশ কয়েকটি ক্লিনিক থেকে তাকে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয় যে, ‘সিজারিয়ানের সংখ্যা বাড়াতে না পারলে ক্লিনিকে তার বসার দরকার নেই। স্বাভাবিক জন্মদানের ব্যবস্থা তো ক্লিনিকে কর্মরত নার্সরাই করতে পারে, এ জন্য একজন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই।’ ওই গাইনোকলজিস্ট শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন সিজারিয়ানে যেতে। কারণ সরকারি হাসপাতালে যে বেতন তিনি পান তা দিয়ে তার সংসার ভালমতো চলতে পারছে না। তার উচ্চশিক্ষারত ছেলেমেয়েদের জন্য অর্থের প্রয়োজন। বাধ্য হয়ে এখন তিনি সিজারিয়ান করছেন।
অবশ্য কিছু চিকিৎসক স্বাভাবিক জন্মদানে মোটেও আগ্রহী নয়। সিজার করলেই চিকিৎসক খুব অল্প সময়ে অনেক অর্থ পেয়ে থাকেন। রাজধানীর শনির আখড়ায় গৃহবধূ ‘সামারাহ জাকির’ (২৭) একজন গাইনোকলজিস্টকে তার প্রথম গর্ভবতি হওয়ার শুরু থেকেই দেখিয়ে আসছিলেন। সামারাহ চিকিৎসককে শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, যত কষ্টই হোক তিনি স্বাভাবিক প্রসবে আগ্রহী। ওই গাইনোকলস্টিও তাকে আশ্বাস দিয়ে আসছিলেন যে, তিনি স্বাভাবিক প্রসব করিয়ে দেবেন। সামারাহ এই প্রতিবেদককে জানান, ‘কিন্তু প্রসব ব্যথা উঠার দিন ওই গাইনোকলজিস্টের ক্লিনিকে ভর্তি হলে রাতেই তিনি সামারাহকে জানান, ‘সামারাহ’র পানি কমে গেছে। বেশি দেরি করলে গর্ভের শিশুর মৃত্যু হতে পারে। শিশুকে বাঁচাতে হলে রাতের মধ্যেই সিজারিয়ানে যেতে হবে।’ সামারাহ জানালেন, ‘ভয়ে তিনি চিকিৎসকের কথা মেনে সিজার করতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু সামারাহের এখনো বিশ্বাস, তার কোনো সমস্যা ছিল না। স্বাভাবিক সন্তান জন্মদান করা সম্ভব ছিল। কারণ এর আগে ওই চিকিৎসক একবারও বলেননি যে তার কোনো ধরনের জটিলতা আছে।’
অবসট্রেটিক অ্যান্ড গাইনোকলিকেল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা: রওশন আরা বেগম জানিয়েছেন, ‘অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করলে মা ও সন্তান দু’জনই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এ সময় বিভিন্ন ধরনের চেতনা এবং ব্যথানাশক দেয়া হয় মাকে। এর প্রভাব পড়ে মা এবং নবজাতকের ওপর। আবার অস্ত্রোপচারে শিশুমৃত্যু হারও বেড়ে যায়। মায়ের বুকের দুধ শুরু করাতেও সমস্যা হয়। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের সাথে অপরিণত শিশু জন্মেরও সম্পর্ক রয়েছে। যার ফলে শিশু প্রতিবন্ধী ও মেধাশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।’
এত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও দেশে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বেড়েছে অনেক। তবে ইদানীং করোনার কারণে ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে মায়েরা কম আসছেন। ফলে করোনাকালে সিজারিয়ানের হারও অনেক কমেছে। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক বলছেন, করোনার কারণে হয়তো সিজারিয়ান কম হচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে এটা সাময়িক। করোনাভীতি শেষ হয়ে গেলেই সিজারিয়ান বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ সবাই নয় তবে কিছু কিছু চিকিৎসক ইচ্ছা করেই অর্থের লোভে সিজারিয়ান করে থাকেন।’
এমনিতেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে মোট জন্মদানের ২৩ শতাংশ সিজারিয়ানের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু বেসরকারি ক্লিনিকের ৮০ শতাংশ জন্মদান হয়ে থাকে সিজারিয়ানের মাধ্যমে। অবশ্য মা ও সন্তানের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসব সিজারিয়ানে করানোর সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।


আরো সংবাদ



premium cement