২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাষ্ট্রপক্ষ জবাব না দেয়ায় এক যুগেও ক্রসফায়ার নিয়ে রুলের শুনানি হয়নি

আইনে নেই তারপরও চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
-

আইনের কোথাও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা নেই; কিন্তু তারপরও চলছে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং দিন দিন তা বাড়ছে। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হন। উচ্চ আদালতের এক আদেশে কিছু দিনের জন্য ক্রসফায়ার বন্ধ হয়েছিল। হাইকোর্ট পুলিশের হেফাজতে যারা থাকবে তাদের নিরাপত্তা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল ওই আদেশ পরিবর্তন করেন বলে আইনজীবীরা অভিযোগ করেন। অন্য দিকে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে ভুক্তভোগী পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো উচ্চ আদালতে কয়েকটি রিট আবেদন করেছে। হাইকোর্টও স্বপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে একটি রুল জারি করে রাষ্ট্রের কাছে জবাব চেয়েছেন। কিন্তু গত এক যুগেও রাষ্ট্রপক্ষ ক্রসফায়ার নিয়ে উচ্চ আদালতের রুলের জবাব আসেনি। রিট আবেদনকারী আইনজীবীরা জানান, রুলের শুনানির জন্য আমরা বারবার আদালতের লিস্টে এনেছি। লিস্টে আনার পর দেখা গেছে, আদালত পরিবর্তন হয়ে যায় বা আদালত ছুটি হয়ে যায়। এসব কারণে বারবার পিছিয়ে যায়, শুনানি হয় না।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, যারা রিট আবেদন (ক্রসফায়ার নিয়ে) করেছেন তারা আমাকে রিটের নাম্বার দিলে আমি সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টকে বলে দেবো তাড়াতাড়ি জবাব দেয়ার জন্য। তিনি আরো বলেন, সংশ্লিষ্ট আইনজীবী আমাকে রিট আবেদনগুলোর নাম্বার দিলে আমি দেখব। আমি সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট ও মিনিস্ট্রিকে বলব জবাব দেয়ার জন্য।
এ বিষয়ে রিট আবেদনকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, তারা (রাষ্ট্রপক্ষ) নাম্বার জানে তারপরও আমি নাম্বার দিয়ে দেবো। বুধবারই মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে আমি রিট আবেদনগুলোর নাম্বার দিয়ে দেবো।
ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে হাইকোর্টের জারি করা রুলের ওপর দীর্ঘ দিনও কেন শুনানি হচ্ছে না, সে বিষয়ে রিট আবেদনকারী আইনজীবী মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোর্টের জারি করা রুলগুলো এখন পেনডিং আছে। সরকার এখনো জবাব দেয়নি। আমার রিটগুলোর এখনো জবাব পাইনি। তিনি বলেন, আমার রিট আবেদন ছাড়াও ক্রসফায়ার নিয়ে হাইকোর্টের একটি সুয়োমোটো রুল রয়েছে এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রেরও একটি রিট আবেদন রয়েছে।
তিনি বলেন, রুলের শুনানির জন্য আমরা বারবার আদালতের লিস্টে এনেছি। লিস্টে আনার পর অনেক দিন অপেক্ষা করার পর লিস্টে আসে তখন আবার আদালত পরিবর্তন হয়ে যায় বা আদালত ছুটি হয়ে যায়। আর আদালত যেহেতু দেখে সরকার এখন পর্যন্ত রুলের জবাব দেয়নি। এসব কারণে বারবার পিছিয়ে যায়, শুনানি হয় না। আর আদালত সুয়োমোটো যে রুল দিয়েছিলেন তার শুনানি অনেক এগিয়ে এসেছিল।
তিনি বলেন, সরকার রুলের জবাব না দিলেই সেটি পরোক্ষ রকমের বাধা। তিনি বলেন, আমার একটি রিট আবেদনে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চের আদেশে ক্রসফায়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটি আবেদন আমি করেছিলাম যে, পুলিশের হেফাজতে যারা থাকবে তাদের নিরাপত্তা পুলিশ দেখবে। এই আবেদন আদালত অ্যালাও করেছিল। এর সাথে সাথে ক্রসফায়ার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল ওই আদেশ পরিবর্তন করালেন। পরিবর্তন করার কারণে এর পর থেকে ওইভাবে আছে। আর এখন ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ভাইরাসের মতো হয়ে গেছে। কক্সবাজারের যে ঘটনা ঘটেছে সেটি তো মাদক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে করেছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। এটা তো হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আইনের কোথাও নেই; কিন্তু তারপরও চলছে এবং দিন দিন বাড়ছে। এ ব্যাপারে আমার মনে হয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। সরকারের চিন্তাভাবনা করা দরকার, বাহিনীরও চিন্তাভাবনা করা দরকার। এতে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক হত্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বাহিনীর ভাবমূর্তিরও সঙ্কট হয়। তিনি বলেন, নারায়াণগঞ্জের ঘটনার পর এখন পুলিশের হাতে বেশি ক্রসফায়ার হচ্ছে। এখন ক্রসফায়ারের টোটাল যে সংখ্যা তাতে র্যাবের চেয়ে পুলিশের হাতে বেশি ঘটছে। আবার অনেকসময় ক্রসফায়ারের কথা বলে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হয়, সেটি জানা যায় না। আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে আমাদের কাছে এসব ঘটনার কথা বলে। আদালত ইচ্ছা করলে হস্তক্ষেপ করে ক্রসফায়ার বন্ধ করতে পারে। আদালত অনেকসময় ইচ্ছা করলেও সরকার ও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের কারণে হয়তো করতে পারেন না। তবে আদালত এটার সমাধান করতে পারে, সরকারও করতে পারে এবং বাহিনীও সমাধান করতে পারে। যে কেউ একজনের করা উচিত তা হলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
আইনজীবীরা জানান, ২০০৬ সালে ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় ক্রসফায়ারে নিহত টুন্ডা ইসমাইলের ভাই প্রথম রিটটি করেন। ওই বছরই হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ ৫০০টি ঘটনা নিয়ে দ্বিতীয় রিটটি করে। এসব ঘটনার কেন যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানাতে আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি রুল জারি করেছিলেন। এরপর ২০০৯ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও অবৈধ ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং কর্মজীবী নারী জনস্বার্থে ২০০৯ সালের ২১ জুন হাইকোর্টে রিট করেন। রিটটির প্রাথমিক শুনানি গ্রহণের পর ২৯ জুন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। ‘ক্রসফায়ারের’ নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে নাÑ এ মর্মে কারণ দর্শাতে বলা হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র্যাবের মহাপরিচালক ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়; কিন্তু সেই রুলেরও জবাব দেয়নি সরকার।
এরপর ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর মাদারীপুরে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ভাই লুৎফর খালাসী (৪৫) ও খায়রুল খালাসী (৩০) নিহত হন। ‘সংবাদমাধ্যমে এ খবর জেনে’ বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান ও বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ পরদিন সুয়োমোটো রুল জারি করেন। আদালত রুল জারি করে আর যেন ক্রসফায়ার না ঘটে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কাছ থেকে অঙ্গীকারও নিয়েছিলেন। এরপর সরকারপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছরের ১৪ ডিসেম্বর অবকাশ শেষে আদালত খোলার এক সপ্তাহ পর ওই রুলের শুনানির দিন ধার্য করা হয়। তবে ওই দিন বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান ও বিচারপতি মো: ইমদাদুল হক আজাদের হাইকোর্ট বেঞ্চে সময় আবেদন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত শুনানি মুলতবি রাখতে আবেদন করেছিলেন রাষ্ট্রপক্ষ। ক্রসফায়ার বন্ধ রাখার মৌখিক নির্দেশ দিয়ে ওই সময় পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন হাইকোর্ট। অ্যাটর্নি জেনারেল আশ্বস্ত করেছিলেন আর ক্রসফায়ার হবে না। বার্ষিক অবকাশ শেষে ৩ জানুয়ারি উচ্চ আদালত খোলার পর দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো: তাফাজ্জাল ইসলাম পুনর্গঠন করেন বেঞ্চ। ভেঙে দেয়া হয় বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান ও মো: ইমদাদুল হক আজাদের বেঞ্চ। যে কারণে এখন পর্যন্ত এ সুয়োমটো রুলের শুনানি শুরু হতে পারেনি।
এ দিকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকণ্ড ঘটেছে ১৯৬টি। ২০১৯ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৮৮টি, ২০১৮ সালে ৪৬৬টি, ২০১৭ সালে ১৬২ জন মানুষকে বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ছিল ১৯৫টি, ২০১৫ সালে ১৯২টি, ২০১৪ সালে ১৫৮টি এবং ২০১৩ সালে ২০৮টি।
মাদকের ভয়াবহতা ঠেকাতে ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই অভিযানে শুধু কক্সবাজার জেলাতেই পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ২৮০ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা ৯৩ জন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬৯ জন, বিজিবির সঙ্গে ৬০ জন ও র্যাবের সঙ্গে ৫১ জন।

 


আরো সংবাদ



premium cement