২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
পঞ্চবটি-মুক্তারপুর উড়াল সড়ক

কিলোমিটারে ব্যয় শত কোটি টাকা

প্রকল্প খরচ ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা; প্রতি একর জমি ১৮.৭৯৭৪ কোটি টাকা
-

নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত দু’লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হবে। ওই মহাসড়কে প্রতিদিন যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন ১৭ হাজার ৯১০টি যানবাহন চলাচল করে। এই যানবাহনের চাপ আগামী ২০৩৩ সালে ৩৯ হাজারে উন্নীত হবে। র্যাম্পসহ প্রতি কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি ১৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা। প্রতি একর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা। পাঁচ বছর দু’মাস বা ৬২ মাসে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদকাল প্রস্তাব করা হয়েছে বলে সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে সড়ক ও উড়াল সড়ক নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশে সস্তায় শ্রম থাকার পরেও প্রতি কিলোমিটারে এই নির্মাণ ব্যয় বেশি।
সেতু বিভাগের পাঠানো প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত বিদ্যমান সড়ক দুই লেনে প্রশস্তকরণ এবং দুই লেনবিশিষ্ট এলিভেটেড একপ্রেসওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলার সাথে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা সহজতর ও ব্যয় সাশ্রয়ী করা। পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর সড়কের প্রশস্ততা গড়ে ৬ মিটার। দৈনিক যানবাহন চলাচল করছে গড়ে ১৭ হাজার ৯১০টি। ট্রাফিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই যানবাহনের সংখ্যা হবে আগামী ২০২৩ সালে দৈনিক গড়ে ২৩ হাজার ৯২০টি, ২০১৮ সালে ৩০ হাজার ৫৬০টি, ২০৩৩ সালে ৩৯ হাজারটি এবং ২০৪৩ সালে ৬৩ হাজার ৫৮০টি।
এই সড়কের পঞ্চবটি থেকে কাশিপুর পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার বিদ্যমান অ্যাট-গ্রেড সড়ক দুই লেনে উন্নীতকরণ করা হবে। পাশাপাশি দ্ইু লেন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। কাশিপুর অবস্থানে দুই অংশে বিভক্ত। একটি অংশে অ্যাট-গ্রেডে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর রাউন্ড অ্যাবাউট বা বক্র পর্যন্ত বিদ্যমান সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। অপর অংশটি কাশিপুর থেকে কাশিপুর খালের পাশ দিয়ে সৈয়দপুর পর্যন্ত ২.৮ কিলোমিটার দুই লেন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। এই অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর বক্র পার হয়ে অ্যাট-গ্রেড সড়কের সাথে মিলিত হবে। তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর বক্র থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত ২.৩ কিলোমিটার বিদ্যমান অ্যাট-গ্রেড সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি হবে দু’লেনের এবং একটি জরুরি লেন থাকবে। যার দৈর্ঘ্য ৬.২৬ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১১.৪ মিটার।
প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলোÑ ৪৪.৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন, মাটির কাজ, ১০.৭৫ কিলোমিটার পেভমেন্ট ও আনুষঙ্গিক কাজ, ১৪.৭১ কিলোমিটার মধ্যবর্তী প্রতিবন্ধক নির্মাণ, র্যাম্পসহ উড়াল সড়ক (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে), ২৫ মিটার সেতু নির্মাণ, ২৫.৩১ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ এবং ২৪৮ ঘন মিটার বক্স কালভার্ট নির্মাণ। এখানে ছয়টি র্যাম্প, চারটি টোল প্লাজা, যানবাহনের ওজন মাপার জন্য ছয়টি ওজন স্টেশন নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পে র্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল সড়ক হবে ৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার। যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯০৬ কোটি ৭৩ লাখ ২২ হাজার টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে বাস্তবায়নকারী সংস্থার দর অনুযায়ী, ১০০ কোটি ১৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা। বিভিন্ন ওয়েব থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী কলকাতায় গত বছর চালু করা হয় মহানগরীর দীর্ঘতম পরমা ফ্লাইওভার। ৮ দশমিক ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই ফ্লাইওভার নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩৯২ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ খরচ ৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের শত কিলোমিটারের দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি খরচ হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। আর মালয়েশিয়ায় ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় হয়েছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
প্রকল্পে ৪৪ দশমিক ৪৯৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে খরচ ধরা হয়েছে ৮৩৬ কোটি ৩৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। ফলে একরপ্রতি ভূমির দর হচ্ছে ১৮ কোটি ৭৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। সড়কের জন্য ১০ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার পেভমেন্ট ও আনুষঙ্গিক কাজ করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৮ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২৫.৩১ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করতেই ব্যয় হবে ৩৩ কোটি ৪৪ লাখ ১২ হাজার টাকা। প্রতি কিলোমিটার ড্রেনে ব্যয় হবে ১ কোটি ৩২ লাখ ১২ হাজার টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সংশ্লিষ্ট উইংয়ের যুগ্ম প্রধান অঞ্জন কুমার বিশ্বাসের মতামতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। প্রকল্পের অনুকূলে জিওবি অর্থের বিষয়ে অর্থ বিভাগের মনিটরিং সেল থেকে ছাড়পত্র সংগ্রহ করে ডিপিপিতে সংযুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের ১০ থেকে ২০ শতাংশ ব্যয় সেতু কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থের সংস্থান রাখা যেতে পারে। প্রকল্পে সাড়ে ৪৪ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৮৩৬ কোটি ৩৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ব্যয় প্রাক্কলন সংযুক্ত করা হয়নি।
কমিশন বলছে, প্রকল্পের আওতায় ১০.৭৫ কিলোমিটার পেভমেন্ট ও আনুষঙ্গিক কাজ প্রস্তাব করা হয়েছে। পেভমেন্টের ডিজাইন ডিপিপিতে দেয়া হয়নি। ২৫.৩১ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণের প্রস্তাবের যৌক্তিকতা দেখা দরকার।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা ও দুর্নীতির কারণেই বাংলাদেশে প্রকল্প খরচ অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি।


আরো সংবাদ



premium cement